ঢাকা ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদ

২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নিহত ৯

২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নিহত ৯

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে গত ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত ২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে ৯ জন নিহত হয়েছেন। চারজন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে একজন বাকপ্রতিবন্ধী। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য তুলে ধরেছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ। এই কদিনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার তথ্য এখানে তারা তুলে ধরেছে। সারাদেশ থেকে ঐক্যপরিষদ নিজেরা এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে। ঐক্যপরিষদ বলছে, এসব ঘটনার সবগুলোই সাম্প্রদায়িক, রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা তারা লিপিবদ্ধ করেনি। সংবাদ সম্মেলনে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার এসব তথ্য তুলে ধরেন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি নির্মল রোজারিও। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মধ্যে ৯ জনকে হত্যা, ৪ জনকে ধর্ষণ-গণধর্ষণ, ৬৯টি উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ; ৯১৫টি বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ; ৯৫৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ; বসতবাড়ি দখল একটি; ৩৮টি শারীরিক নির্যাতন এবং ২১টি জমি-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখলের ঘটনা ঘটেছে।

প্রতিবেদনে তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৬৮টি জেলা ও মহানগর এলাকায় সর্বমোট ২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় ১ হাজার ৭০৫টি পরিবারের সদস্যরা সরাসরি আক্রান্ত হয়েছেন। এই পরিবারগুলোর মধ্যে ১৫৭টি পরিবার রয়েছে, যাদের বসতবাড়িতে হামলা চালিয়ে লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার ১ হাজার ৭০৫টি পরিবারের মধ্যে খুলনা বিভাগে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয়েছে, যেখানে ৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১ জন বাকপ্রতিবন্ধী।

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার ১ হাজার ৭০৫টি পরিবারের মধ্যে ৩৪টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবার রয়েছে, যাদের বসতবাড়ি লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে কয়েকটি পরিবারের জমি জবরদখল করা হয়েছে।

৬৯টি উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি বিভাগেই এ ঘটনা ঘটেছে এবং হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের উপাসনালয় ও লোকজন আক্রান্ত হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় প্রায় ৫০ হাজার নর-নারী, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান কিশোর-কিশোরী, শিশু ও প্রতিবন্ধী মানুষ সরাসরি আক্রান্ত আক্রান্ত হয়েছেন এবং সারাদেশে আনুমানিক ২ কোটি ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী, যারা বর্তমানে আতঙ্ক ও ভয়ের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন।

১৫৭টি পরিবার রয়েছে যারা বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, অর্থ-সম্পদ সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবন যাপন করছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে খুলনা বিভাগে, ৮১০টি। তারপর রাজশাহী বিভাগে ২৯৭টি, রংপুর বিভাগে ২৭১টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ২২৪টি, ঢাকা বিভাগে ১৬০টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১০০টি, বরিশাল বিভাগে ৮৬টি ও সিলেট বিভাগে ৬২টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলন থেকে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মানবতাবিরোধী সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনাবলির সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করা হয়েছে। ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্তসহ সংগঠনের অন্য নেতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে। চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অবসান, দোষীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ পুনর্গঠনে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ঐক্যপরিষদ কয়েক দফা প্রস্তাব জানিয়েছে সংবাদ সম্মেলনে। সেগুলো হলো, সব রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ও সংসদের প্রতিটি অধিবেশনের সূচনায় পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করে সব ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের পদক্ষেপ গ্রহণ করা; সংবিধানে বিদ্যমান সাংবিধানিক বৈষম্যদূরীকরণের লক্ষ্যে ১২ক অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক রাষ্ট্রধর্ম সংবলিত ২ক অনুচ্ছেদের বিলোপ করা; সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় শিক্ষায়তনের উন্নয়ন ও বিকাশে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ধর্মীয় শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর বৈষম্য দূর করা; ধর্মীয় বাজেটে বিরাজিত বৈষম্য দূর করে আমানতের সুদের টাকায় পরিচালিত ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টগুলোকে ফাউন্ডেশনে রূপান্তর করা; সাম্প্রদায়িক উসকানি ও কটূক্তির প্রতিকারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাব্যবস্থায় যাবতীয় ধর্মীয় বৈষম্যের অবসান করা।

সংবাদ সম্মেলনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অস্তিত্ব রক্ষায় ৮ দফা জানানো হয়। সেগুলো হলো সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা; জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন করা; অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের যথাযথ প্রয়োগে যাবতীয় আমলাতান্ত্রিক বাধা অপসারণ করে ট্রাইব্যুনালের রায়ের আলোকে জমির মালিকানা ও দখল ভুক্তভোগীদের বরাবরে অনতিবিলম্বে প্রত্যর্পণ করা; জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে সরকারে, সংসদে, জনপ্রতিনিধিত্বশীল সব সংস্থায় অংশীদারত্ব ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা; দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণে আইন প্রণয়ন করা হোক (এরই মধ্যে খসড়া বিল চূড়ান্তকৃত); বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন করা (এরই মধ্যে খসড়া বিল চূড়ান্তকৃত); পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনের যথাযথভাবে কার্যকর করা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গাপূজায় অষ্টমী থেকে দশমী- এই ৩ দিন, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রবারণা পূর্ণিমায় ১ দিন ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ইস্টার সানডেতে এক দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত