নতুনভাবে বাংলাদেশে ঢুকছে রোহিঙ্গারা
প্রকাশ : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
সরকারি হিসাবে গত দেড় মাসে নতুন এমন অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা আট হাজারেরও বেশি। তবে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, বাস্তবে নতুন করে ঢোকা রোহিঙ্গার সংখ্যা এর দ্বিগুণ। বাংলাদেশে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে আট লাখ রোহিঙ্গা ঢুকেছে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী কয়েকমাসে। সরকার অবশ্য বলছে, নতুন করে আর একজন রোহিঙ্গাকেও আশ্রয় দেয়ার মতো অবস্থায় নেই বাংলাদেশ। যদিও মিয়ানমারে সংঘর্ষ চলতে থাকায় বাংলাদেশ যেন নতুন করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয় সে বিষয়ে চাপ আছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের।
বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গঠিত নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করতে পারবে কি না সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
সেখানকার বাসিন্দা জেসমিন মাসখানেক আগে এসেছেন বাংলাদেশে। সঙ্গে তার স্বামী ও এক সন্তানও এসেছে। বাংলাদেশে আসার পর তারা অবস্থান নিয়েছেন কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে। জেসমিনের বক্তব্য অনুযায়ী, গত মাসে শিকদার পাড়ায় আরাকান আর্মির ছোড়া বোমার সিপ্লন্টারের আঘাতে গুরুতর আহত হওয়ার পর বাংলাদেশে না এসে আর কোনো উপায় ছিল না তাদের। বোমার সিপ্লন্টার তার ডান পায়ে আঘাত করার পর সেই পা কেটে ফেলতে হয় বলে জানাচ্ছেন জেসমিন। ‘দুপুরের দিকে আমি বাসাতেই ছিলাম। হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পাই। তারপর আর কিছু মনে নেই। কারণ আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমার ডান পা থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। মিয়ানমারে চিকিৎসার কোনো সুযোগ ছিল না। শুধু ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। আমার প্রাণ বাঁচাতে আমার স্বামী পরিবার নিয়ে বাংলাদেশ চলে আসতে বাধ্য হয়। জেসমিনের পরিবার নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। এখানে ঢোকার পর তার আশ্রয় হয় একটি আন্তর্জাতিক এনজিও’র হাসপাতোলে। জেসমিন বলেন, ‘মিয়ানমারে আমার ঠিকমতো চিকিৎসা হয় নাই। ওই অবস্থাতেই এক দিন পর বাংলাদেশে ঢুকি। এখানে চিকিৎসা চলতে থাকলেও পরে দেখা যায় ডান পায়ে আঘাতের জায়গায় ইনফেকশন হয়েছে। পরে ইনফেকশনের কারণে আমার পা কাটতে হয়েছে। তবে পা হারালেও আমি বেঁচে আছি, আমার পরিবার বেঁচে আছে। এটাই সান্ত¡না।’ বাংলাদেশে আসা নতুন রোহিঙ্গারা জানাচ্ছেন, সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার অংশে এখনো অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢোকার অপেক্ষায় আছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ এড়াতে তারা রাতের বেলায় নৌকায় করে নাফ নদী পেরিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে। জেসমিন জানাচ্ছেন, তার ভাষায়, গুরুতর আহত হওয়ায় ‘মিয়ানমারের সেনা সদস্যরাই তাকে পরিবারসহ একটি ছোট নৌকায় উঠিয়ে দেয়’। ভোর ৪টার দিকে তাদের নৌকা নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এ জন্য নৌকার মাঝিকে দিতে হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। জেসমিনের মতোই সপ্তাহ দুয়েক আগে বাংলাদেশে ঢুকেছেন আছিয়া। ২০১৭ সালে তার বাবা-মা বাংলাদেশে এলেও আছিয়া তার স্বামীর সঙ্গে মিয়ানমারেই থেকে যান। কিন্তু এখন মিয়ানমার জান্তার সঙ্গে বিদ্রোহীদের সংঘর্ষের তীব্রতা বাড়ায় জীবন নিয়ে মিয়ানমারে বেঁচে থাকার উপায় নেই। আছিয়ার স্বামী ওসমান গনি বলেন, যুদ্ধের মধ্যে এখন মিয়ানমারে থাকা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘আমরা কিন্তু এর আগেরবার বাংলাদেশে আসিনি। সেখানে আমাদের বাড়িঘর আছে, জমি আছে, সম্পদ আছে। কিন্তু এখন যেভাবে দুই পক্ষ গোলাগুলি করছে, তারা দেখছে না যে কে সাধারণ মানুষ আর কে যোদ্ধা। আমাদের গ্রামে যখন বোমায় মানুষ মারা গেলো, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে মিয়ানমারে আর থাকা যাবে না।’
কিন্তু তারা বাংলাদেশে ঢুকলেন কিভাবে? ওসমান গনি জানিয়েছেন, প্রথমে পায়ে হেঁটে তারা বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে এসেছেন। আমাদের গ্রামে প্রথমে আরাকান আর্মি ড্রোন হামলা করে। তখন আমরা গ্রামের বেশ কিছু লোক দুই দিন পাশের একটা বনে লুকিয়ে ছিলাম। কোনো খাবার ছিল না। কিন্তু সেখানেও আরাকান আমি ড্রোন দিয়ে বোমা মেরেছে। পরে আমরা নদীতে গলা পানিতে ডুবে থেকে কোনোমতে জীবন বাঁচাই। আমরা সীমান্তের কাছে চলে আসি।’ ওসমান গনি বলছেন, নদী পারাপারের জন্য তাদের কাছে কোনো টাকা ছিল না। কিন্তু তারা বহু কষ্টে নদী পার হওয়ার জন্য একজন মাঝির সঙ্গে চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী, স্বামী-স্ত্রী এবং সন্তানের জন্য ২০ হাজার টাকা দিতে হয় মাঝিকে। আমরা যেন বাংলাদেশের কোস্ট গার্ডের কাছে ধরা না পড়ি সেজন্য মধ্যরাতে নৌকা ছাড়ে। আমাদেরকে নামানো হয় শাহপরী দ্বীপের কাছে। পরে নৌকার মাঝি আমাদেরকে স্থানীয় একটি গ্রামে একটা ঘরে নিয়ে রশি দিয়ে বেঁধে রাখে। ক্যাম্পে আমাদের আত্মীয়ের কাছে ফোন দিলে তারা এসে চুক্তির ২০ হাজার টাকা তুলে দেয় মাঝিকে। এরপর তারা আমাদের ছেড়ে দেয়।’ ওসমান গনি জানান, মিয়ানমারে তারা বাবা-মা আছেন। কিন্তু তারা বেঁচে আছেন কিনা তিনি জানেন না।
সরকারি স্বীকৃতি ছাড়া রোহিঙ্গারা কোথায় থাকছেন ?
বাংলাদেশে গত দেড় মাসে নতুন করে যেসব রোহিঙ্গা ঢুকেছে, সরকারি হিসেবে তাদের সংখ্যা আট হাজারেরও বেশি। সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান। কিন্তু স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, বাস্তবে এ সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে দ্বিগুণ। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের সরকার আশ্রয় না দেয়ায় তারা গোপনে বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন এবং পূর্বপরিচিতদের ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। এতে করে আগে থেকেই গাদাগাদি অবস্থায় থাকা পরিবারগুলো নতুন করে চাপে পড়েছে।
রুহুল আমিন নামে একজন জানাচ্ছেন, তার পাঁচ সদস্যের পরিবারে নতুন করে আসা আত্মীয় অবস্থান করছেন চারজন। কিন্তু এখন পুরো নয়জনের খাবার চলছে, পাঁচজনের জন্য যে বরাদ্দ আসে সেখান থেকে। এভাবে কতদিন চলবে তা নিয়ে সন্দিহান রুহুল আমিন। তার দাবি, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের যেন বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃতি দেয়। তাহলে তারা নতুন ঘর এবং খাবারসহ অন্যান্য বারদ্দ পাবে।
সরকার যা বলছে?
বাংলাদেশে এবারের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এমন এক সময় ঘটছে, যখন দেশটিতে গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমারে নতুন করে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাংলাদেশের উপর বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপ থাকলেও শেখ হাসিনা সরকার সেটা অগ্রাহ্য করেছে। কিন্তু নতুন সরকার সেটা কতটা পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।