ঢাবিতে তোফাজ্জল হত্যা

গ্রেপ্তার জালালের সর্বোচ্চ শাস্তি চায় এলাকাবাসী

প্রকাশ : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  রঞ্জন কৃষ্ণ পণ্ডিত, টাঙ্গাইল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) বরগুনার যুবক তোফাজ্জলকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জালাল আহমেদের সর্বোচ্চ শাস্তি চায় এলাকাবাসী। তিনি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার আনেহলা ইউনিয়নের সাইটশৈলা গ্রামের প্রতিবন্ধী আলতাফ হোসেনের ছেলে।

সরেজমিন জানা যায়, ঢাবির পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী জালাল আহমেদ অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। গ্রামের বাড়িতে জালাল বা তার পরিবারের কোনো ঘরবাড়ি নেই, জায়গা জমিও নেই। জালালের প্রতিবন্ধী বাবা আলতাফ হোসেন অসুস্থ। স্ত্রীসহ ভূঞাপুর উপজেলার নিকরাইল ইউনিয়নের পাথাইলকান্দি এলাকায় ১ হাজার ৫০০ টাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। ওই পাথাইলকান্দি বাজারেই তারা চাপড়া বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ছেলেকে মাঝেমধ্যে টাকাও পাঠান তিনি। জালাল ছোটবেলা থেকেই বেশ মেধাবী।

স্থানীয়রা জানায়, পরিবারের ছোট ছেলে জালাল। তার বড় ভাই আল-আমিন স্ত্রীসহ অন্যের বাড়িতে থাকেন। বোনের বিয়ে হয়েছে পাশের কালিহাতী উপজেলার নারান্দিয়াতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পর এলাকায় তেমন একটা আসেন না জালাল। এলাকায় ভদ্র, নম্র ও মেধাবী হিসেবে পরিচিত।

শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর জালাল টাঙ্গাইলে তার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। নিজের বাড়িঘর না থাকায় গ্রামে বিভিন্ন বন্ধুদের বাড়িতে তিনি ৪-৫ দিন ছিলেন। এলাকাবাসী জানায়, মেধাবী হওয়ায় গ্রামের মানুষজন জালালের লেখাপড়ার খরচের জোগান দিতেন। এছাড়া ছেলের পড়াশোনায় জালালের বাবা আলতাফ যতটুকু সামর্থ্য তা দিয়েছেন। সম্প্রতিও চাপড়া বিক্রির ৬ হাজার টাকা ছেলেকে দিয়েছিলেন আলতাফ। ঢাকায় কোনো রাজনীতির সঙ্গে জালাল জড়িত ছিল কি না সেটা পরিবার, আত্মীয়-স্বজন বা এলাকার কেউ জানতেন না। তবে জালালের বাবা বিএনপির একজন সমর্থক। তার ছেলে ছাত্রলীগ করতেন এটাও তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ডের পরই জেনেছে এলাকাবাসী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জালাল আহমেদ ঘাটাইলের সাইটশৈলা সরকারি প্রাথমিক শেষে সাইটশৈলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও এলেঙ্গার শামছুল হক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাবিতে ভর্তি হন। এরপর থেকেই পরিবর্তন ঘটে জালালের। স্থানীয়দের সহায়তা ও বাবার দেয়া সামান্য টাকা এবং টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ চালানো জালাল এখন হত্যা মামলার আসামি। এলাকাবাসী জানায়, এলাকার মানুষের কাছে জালাল একজন উদাহরণ দেয়ার মতো ছাত্র। কিন্তু একটি ঘটনায় তার এবং তার পরিবারের সব আশা নিরাশায় পরিণত হয়েছে। মেধাবী জালাল এখন খুনের দায়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার। এলাকার মানুষ টিভিতে না দেখলে এটা বিশ্বাসই করতো না। সাইটশৈলা গ্রামের কায়কোবাদ হোসেন জানান, জালাল খুবই মেধাবী শিক্ষার্থী। এলাকাবাসী টাকা-পয়সা তুলে তার পড়াশুনার খরচ চালিয়েছে। গ্রামে কোনো রাজনীতি করতেন না তিনি। তার বাবা বিএনপি সমর্থন করেন। তবে ছেলেটা কেন বা কীভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গেল সেটা অবাক করার মতো বিষয়। কাউকে এভাবে পিটিয়ে মারবে জালাল এটা কল্পনাতীত। জালালের চাচা চান মিয়া জানান, কয়েক বছর ধরে তাদের সাথে যোগাযোগ নেই। গ্রামে মাঝে মাঝে আসে কিন্তু তেমন কথা হয় না। হঠাৎই সাইটশৈলা বাজারের টিভিতে দেখলেন- সে একটা ছেলেকে মারধর করছে। এটা ঠিক করেনি। ঘটনার শাস্তি তো সে পাবেই। তারাও এই ঘটনার শাস্তি চায়। জালালের মা কহিনুর বেগম জানান, তিনি ছেলেকে অনেক বুঝিয়েছেন- সে যেন কারোর সঙ্গে খারাপ আচরণ না করে, কাউকে আঘাত না করে। মানুষের অন্যায় না করতে বারবার বুঝিয়েছেন। ঘটনাটি তিনি টিভিতে দেখেন নাই। মেয়ের কাছে শুনেছেন। তার ছেলেকেও যদি ওইভাবে কেউ মারধর করতো তাহলে সেই কষ্ট তারও হতো। জালাল আহমেদের বাবা আলতাফ হোসেন জানান, সবই তার ভাগ্য। থাকার মতো জায়গা-জমি নেই। গ্রামের বাড়ির বাজারে চা বিক্রি করেছেন। চা বানানোর জন্য হাতের আঙুল কেটে যায়। পরে চা আর বিক্রি করতে পারে নাই। অন্যের বাড়িতে থেকেছেন। পরে পাথাইলকান্দিতে স্ত্রীর সহযোগিতায় চাপড়া বিক্রি করছেন। ছোটবেলা থেকেই তার ছেলে কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে। তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। সে চাকরি-বাকরি করবে। তাদের জন্য না হোক সে যেন পড়াশোনা শেষ করে নিজেই ভালোভাবে চলতে পারবে। কিন্তু সব কিছুই শেষ হয়ে গেল। আশা ধ্বংস হয়ে গেল এক নিমিষে। ছেলে পুলিশে আটক হয়েছে তা তিনি জেনেছেন। কিন্তু কে তার খোঁজ নেবে! তিনি নিজে প্রতিবন্ধী মানুষ, তার পরিবারে তেমন কেউ নেই যে ছেলেটার খোঁজ নিবে। জালাল ঢাকায় রাজনীতি করতো কি না তা তিনি জানেন না। প্রসঙ্গত, গত ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় চোর সন্দেহে তোফাজ্জলকে আটক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলের শিক্ষার্থীরা। মূল ভবনের অতিথি কক্ষে নিয়ে তাকে মারধর ও জেরা করতে থাকে। একপর্যায়ে তাকে নিয়ে হল ক্যানটিনে খাওয়ানো হয়। এরপর এক্সটেনশন ভবনের অতিথি কক্ষে নিয়ে দ্বিতীয় দফায় বুক, পিঠ, হাত ও পায়ে ব্যাপক মারধর করে একদল শিক্ষার্থী। মারধরের ফলে তোফাজ্জলের পা থেকে রক্ত বের হতে থাকে। এদিন রাত পৌনে ১০টার দিকে ফের মূল ভবনের অতিথিকক্ষে নিয়ে মারধর করা হয়। এরপর ১০টার দিকে প্রক্টোরিয়াল মোবাইল টিমের সদস্যরা এলে মারধরকারীরা তাকে তাদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে কিছু শিক্ষার্থী ও কয়েকজন হাউজ টিউটরের সহায়তায় তাকে প্রথমে শাহবাগ থানায় এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় ৮ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এরমধ্যে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন- জালাল আহমেদ, মোহাম্মদ সুমন, আহসান উল্লাহ, মুত্তাকীন সাকিন, আল হোসাইন সাজ্জাদ ও ওয়াজিবুল আলম।