পাকিস্তান অবজারভারের নিবন্ধ
শেখ হাসিনার পতন ও স্বৈরাচারী শাসকদের জন্য শিক্ষা
প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ছিলেন বাংলাদেশের লৌহ মানবী এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে। গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে কঠোর দমনপীড়নের পাশাপাশি স্বৈরাচারের মতো দেশ শাসন করেছেন তিনি।
হাসিনার শাসনামল ছিল গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি অবজ্ঞার পাশাপাশি অসহিষ্ণুতাণ্ডঅভদ্রতা ও স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতিতে পূর্ণ। শেখ হাসিনা চরম অহংকারের সাথে শাসন করেছেন এবং তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল- তিনি অপরাজেয় এবং তিনি কেবল অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে শাসন করার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছেন। তবে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ব্যাপক দমনপীড়নের ফলে গণ-রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হলে হাসিনার ক্ষমতার কাঠামো তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভ ও দাবির সামনে হাসিনাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে এবং নিজের সমস্ত সমর্থক ও রাজনৈতিক অনুরাগীদের নিরাসক্ত রেখে খুব তাড়াহুড়ো করে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যেতে হয়েছে। ঢাকায় শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনে অন্যান্য দেশের শাসকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষা রয়েছে। শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত ভালোভাবে কাজ করছে- দিনে দিনে এটি কেবল মিথ বা অতিকথন হিসাবেই প্রমাণিত হয়েছে। কারণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের অথিকথনের পরও দেশটির উপরে ঋণের বিশাল বোঝা, প্রবল বেকারত্ব এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও রয়েছে আকাশছোঁয়া। অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা কোনো শাসকের জন্য টিকে থাকার কোনো নিশ্চয়তা নয় এবং জনগণের ক্ষোভ ও আন্দোলন বিশ্বের যে কোনো স্থানে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সুনিপুণ সরকারেরও পতন ঘটাতে পারে।
হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ সবসময়ই ভারতের মোদি সরকারের সার্বিক সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছিল এবং একপর্যায়ে বাংলাদেশ কার্যকরভাবে তার শক্তিশালী প্রতিবেশীর (ভারতের) একটি স্যাটেলাইট দেশে পরিণত হয়ে যায়। আর এটিই বাংলাদেশি জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে আবির্ভূত হয়। বাংলাদেশের সংবিধান দেশের জনগণকে বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সংগঠনের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। তবে হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে জনগণের সকল মৌলিক ও অপরিহার্য সকল অধিকারই পদদলিত হয়েছে; এর পরিবর্তে সন্ত্রাসের রাজত্ব, কঠোর কারফিউ, রাজনৈতিক বিরোধীদের গ্রেপ্তার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ এবং শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ আন্দোলনকে দমন করার জন্য অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগের জন্যও হাসিনা দায়ী ছিলেন। তিনি পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও উপভোগ করছিলেন। আর তাই তার বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট আনা সম্ভব ছিল না। আর এই কারণে তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের একমাত্র উপায় ছিল- হয় তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা অথবা সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সামরিক আইন জারি করা।
তবে কেবল শিক্ষার্থীদের দৃঢ় শক্তি এবং বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার ফলে বাংলাদেশে সরকারের পতন হয় এবং গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সামরিক হেলিকপ্টারে করে দ্রুত ঢাকা থেকে প্রস্থান করেন এবং ভারতে আশ্রয় নেন। বিশ্বের স্বৈরাচারী শাসকদের বাংলাদেশের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। এটা খুবই স্পষ্ট, জনগণের ইচ্ছাশক্তি এবং ক্ষমতা সবচেয়ে শক্তিশালী স্বৈরাচারী সরকারেরও পতন ঘটাতে পারে। জনগণের ঐক্য খুব শক্তিশালী এবং সুসজ্জিত শাসনকেও অল্প সময়ের মধ্যে কার্যত উড়িয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশে শাসনব্যবস্থার এই পরিবর্তন আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, সামরিক বা নিরাপত্তা সংস্থার মতো শক্তিশালী শক্তির সমর্থন ছাড়াই কেবল একটি জন-আন্দোলন কীভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক বা সরকারের ধ্বংস ও পতন ঘটাতে পারে।
শেখ হাসিনার শাসনামলজুড়ে গভীরতর অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে বিশেষ করে দারিদ্র্য, বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি এবং গুরুতর দুর্নীতিতে বাংলাদেশ জর্জরিত ছিল। কিন্তু বরাবরই সরকারের বক্তব্য ছিল- সবকিছু ঠিক আছে এবং দেশ দ্রুত অগ্রগতির মাধ্যমে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু সরকারের এই মিথ্যা অপপ্রচারের বুদবুদ একসময় ফেটে যায়ই এবং এরপর নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াও সরকারকে সহায়তা করতে পারেনি। বিশ্বের অগণতান্ত্রিক শক্তির জন্য শিক্ষা হলো- গণ-অভ্যুত্থান হলে এবং জনগণের পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে কোনো ধরনের মিথ্যা প্রচারণাই কোনো শাসনব্যবস্থার টিকে থাকা নিশ্চিত করতে পারে না। তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামের মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি হতেই থাকলে তেমনটি আসলে ছাত্র, আইনজীবী বা সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীদের নেতৃত্বে গণ-রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য উত্তম পরিস্থিতি। বাংলাদেশে ঠিক এটাই ঘটেছে এবং এর ফলে দেশটিতে দ্বিতীয় বিপ্লব ও শেখ হাসিনা সরকারের আকস্মিক পতন হয়েছে। যে কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে স্বৈরাচারী শাসন থাকলে সেখানে রাজনৈতিক প্রতিবাদ আন্দোলনের সাফল্যের জন্য একটি অনুঘটক এজেন্ট থাকতে হবে। আর সেই অনুঘটক এজেন্ট আইনজীবী, শিক্ষার্থী, ইউনিয়ন নেতা বা রাজনৈতিক কর্মীরাও হতে পারেন।
বাংলাদেশে আন্দোলনের এই অনুঘটক ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এবং এরপর সারা দেশের ছাত্র-জনতা। শেখ হাসিনা গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় টিকে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার সরকার ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অযোগ্য। জনগণের পক্ষ থেকে পরিবর্তন চাওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন তার সব দোষই হাসিনার সরকারের ছিল। ২০২৪ সালের জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনের পর যখন হাসিনা ক্ষমতায় আসেন, তখন ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল- তিনি আরো পাঁচ বছর দেশ শাসন করবেন। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলন তাকে শীতের আবহাওয়ায় ঝরে পড়া পাতার মতো ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এরপরও সাম্প্রতিক সময়ে আমরা সারা বিশ্বে অসহিষ্ণু শাসনব্যবস্থার দুঃখজনক বৃদ্ধি দেখতে পাই। শেখ হাসিনা নিছক অহংকারের কারণে সতর্কতা সংকেতগুলোকে মানতে অস্বীকার করেছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতে থাকেন- তিনি যে কোনো প্রতিবাদ আন্দোলনই মোকাবিলা করতে বা ঠেকিয়ে দিতে পারেন এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে যে কোনো বিদ্রোহ দমন করতে পারেন। তবে ছাত্র-জনতার দৃঢ় ইচ্ছা ও সংকল্প এবং এর সঙ্গে দেশের আপামর জনগণের সমর্থন তাকে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করে এবং বিশ্বের স্বৈরাচারী শাসকদের এখন এই বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। শেখ হাসিনার বেলায় এটা ঘটতে পারলে তাদের ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারে। বাংলাদেশে হওয়া গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লব থেকে প্রধান যে শিক্ষাটি নেয়া যায় তা হলো- দ্রুত জিডিপি বৃদ্ধি এবং বিশাল রপ্তানি একাই সর্বত্র সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে না। যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায় না এবং শুধুমাত্র উচ্চবিত্তরাই ধনী হতে থাকে, তখন অধিকাংশ মানুষ কোনো উন্নতি দেখতে পায় না বা নিজেদের আরো খারাপ বলে মনে করে। জনগণ তখন সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন এবং জাতীয় আয়ের দাবিতে প্রতিবাদ শুরু করে যার ফলে বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় এই নিবন্ধটি লিখেছেন তারিক আকিল। তিনি ইতিহাসের অধ্যাপক এবং দক্ষিণ এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর এই দেশটির রাজধানী ইসলামাবাদে বসবাস করছেন।