ঢাকা ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

গণপূর্তের বাজেটে তিন শতাধিক থানা মেরামত

স্বাভাবিক হচ্ছে কার্যক্রম
গণপূর্তের বাজেটে তিন শতাধিক থানা মেরামত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজধানীসহ সারা দেশে থানায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। তবে, তাৎক্ষণিক থানা মেরামতে আর্থিক সংকট থাকায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন গণপূর্ত অধিদপ্তরের মেরামতের বাজেট দিয়ে প্রায় তিন শতাধিক থানা-তদন্ত কেন্দ্র মেরামত করা হচ্ছে। এতে গণপূর্তের নিজস্ব ভবন মেরামত খাতে আর্থিক টান পড়েছে বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।

সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে থানায় পুলিশের অবস্থান করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সেজন্য গণপূর্তের ভবন মেরামতে যে বাজেট নির্ধারিত আছে, সেই বাজেট থেকে থানাগুলোর মেরামতের কার্যক্রম চলমান। প্রাথমিক অবস্থায় তিন শতাধিক থানা ও তদন্ত কেন্দ্র মেরামতে প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। মেরামতের বাজেট আরো বাড়তে পারে।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের নীতিমালায় বলা হয়েছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের পরিচালন বাজেটে মেরামত ও সংরক্ষণ খাতের আওতায় আবাসিক ভবন খাতে এবং অনাবাসিক ভবন খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলেন মুখে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালালে সারা দেশে থানাগুলোয় পুলিশি কার্যক্রম ভেঙে পড়ে। থানায় পুলিশের দেখা মেলেনি তেমন। গণপূর্ত অধিদপ্তর থানাগুলো মেরামত করে দেয়ায় থানায় বসতে পারছেন পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অধীন থানা রয়েছে ৫০টি। ডিএমপি সূত্র জানায়, ৫ ও ৬ আগস্ট ২১টি থানাসহ পুলিশের ২১৬টি স্থাপনায় হামলা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। আগুনে পুড়ে যায় ১৩টি থানা। থানা ভবনগুলোর মেরামতকাজ চলছে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, ভাটারা ও মিরপুর মডেল থানার ভবনগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ডিএমপির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের সক্রিয় করার চেষ্টা চলছে। আগুনে পুড়ে যাওয়া এবং ভাঙচুর করা থানাগুলো মেরামত হলেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। এ বিষয়ে ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, পুলিশের নিয়মিত কার্যক্রম চলছে। যেসব থানা অক্ষত রয়েছে, সেসব থানার গাড়ি দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত থানা এলাকায় টহল কাজ চালানো হচ্ছে। আগুনে পুড়ে যাওয়া রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানায় পোড়া ভবনে রং ও আংশিক মেরামত করে কার্যক্রম চালাচ্ছে থানা পুলিশ। জনসাধারণের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে কাজ করছে পুলিশ সদস্যরা। তবে জনবল, যানবাহন ও অন্যান্য ইকুইপমেন্টে সংকটে কমেছে পুলিশি সেবা। আগুনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় যাত্রাবাড়ী থানা। এখন পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী থানার কার্যক্রম শুরু হয়নি। ফলে যাত্রাবাড়ী থানায় যারা সেবা নিতে আসছেন, তাদের বাধ্য হয়ে ডেমরা থানায় যেতে হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের সময়ে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় এখনো অনেক সদস্য ভয়, আতঙ্ক ও ট্রমার মধ্যে আছেন। পুলিশের এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আরো কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। তবে সেটা নির্ভর করবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বর্তমান পুলিশ সদস্যদের সম্পর্ক ও পুলিশিং সেবার মানোন্নয়নের উপর। দেশের আইনশঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে থানার ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে এখনো।

পুলিশ সদস্যরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুলিশ বাহিনীকে দলীয়ভাবে ব্যবহার করায় গত ৫ আগস্ট থানা ও পুলিশের ওপর নজিরবিহীন হামলার ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে নতুন সরকার আগের পুলিশ সদস্যদের সরিয়ে নতুনদের থানাগুলোয় পাঠাচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে পুলিশের প্রতি ক্ষোভ দূর করা এবং সেবা নিশ্চিত করাই রদবদলের উদ্দেশ্য।

কামরাঙ্গীরচর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. আলী জিন্নাহ বলেন, এখানে নতুন যোগ দিয়েছি। দৈনিক বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ নিয়ে থানায় আসছেন সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে মোবাইল হারানোর জিডি ও পারিবারিক কলহ বেশি। মুজিবুর রহমান নামে আরেক পুলিশ সদস্য বলেন, আমাদের বেশিরভাগেরই বদলির অর্ডার চলে এসেছে। আমরা এখন আর নতুন কাজ করতে চাচ্ছি না। কেননা, কোনো মামলা বা ঘটনার তদন্তে গেলে সেটা শেষ করা যাবে না। তাই কিছুটা স্থবিরতা আছে।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের প্রায় এক সপ্তাহ থানার কার্যক্রম শুরু করে পুলিশ। ৫ আগস্টের পর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাঁদাবাজি, মারামারি, দখলদারত্ব ও মাদক সংশ্লিষ্ট মামলা দায়ের হচ্ছে। এসময়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক অভিযোগ, হুমকি ও বিভিন্ন কিছু হারিয়ে যাওয়া অভিযোগে জমা পড়েছে থানায়।

কামরাঙ্গীরচর থানা পাঁচতলা ভাড়া ভবনে কার্যক্রম চলছে। ভবনের নিচতলা ও দোতলায় থানার কার্যক্রম চলে, অন্য ফ্লোরগুলোয় ব্যারাক হিসাবে থানার পুলিশ সদস্যরা থাকেন। হামলার পর থানার বিভিন্ন কক্ষ থেকে মালামাল, অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে যায় নাশকতাকারীরা। ওসির কক্ষ, ডিউটি অফিসারের কক্ষ, পুলিশের থাকার জায়গা ও থানার স্টোররুমে ব্যাপক লুটপাট করা হয়। থানা থেকে ছয়টি অস্ত্র ও ৩২ রাউন্ড গুলি, বিভিন্ন অস্ত্রের ১২টি ম্যাগাজিন লুট করে দুর্বৃত্তরা। এছাড়াও সরকারি ছয়টি গাড়িতে আগুন, ৪০টি গাড়ি ভাঙচুর ও পুলিশের ব্যক্তিগত ১৫টি মোটরসাইকেল লুট করা হয়। এসময় থানা থেকে কম্পিউটার, মনিটর, প্রিন্টার, ফটোকপি মেশিন, পুলিশের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, হেলমেট, হাতকড়াসহ থানার বিভিন্ন সরঞ্জাম ও ব্যারাক থেকে বেশ কয়েকজন পুলিশের ব্যক্তিগত মালামাল লুট করা হয়েছে। সরকারি ও ব্যক্তিগত নিয়ে অন্তত তিন কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান পুলিশ সদস্যরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, জননিরাপত্তায় থানা চালু রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। থানাগুলো সংস্কার বা মেরামত করে পুলিশকে মাঠে ফেরাতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত থানাগুলো দ্রুত মেরামতের কাজ শুরু করতে হবে। আমাদের সবার নিরাপত্তার জন্য থানা সঠিকভাবে সচল রাখা ও ভালোভাবে পুলিশিংয়ের কোনো বিকল্প নেই।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) মহানগরীর থানাগুলোর ক্ষতির তালিকা করেছে। ডিএমপি তাদের মতো করে থানাগুলোকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। থানাগুলোও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আর্থিক খরচ জোগানের মাধ্যমে মেরামতের চেষ্টা করছে। রাজধানীর থানাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে যাত্রাবাড়ী, ভাটারা ও মোহাম্মদপুরের। এসব থানার কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। তবে পুরোপুরি কার্যকর করতে আরো সময় লাগবে। পুলিশ সদস্যরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছেন। থানা মেরামতের বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতারের মুঠোফোনে কয়েকবার কল দিয়েও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত