মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে এমন একজন প্রবীণ পুরুষ রয়েছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার বয়স ১১৯ বছর। তিনি শ্রীমঙ্গলের দুর্গম সীমান্তবর্তী এলাকা মেকানিছড়ার বাসিন্দা রাম সিং গড়। গিনেস বুক অব রেকর্ড অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে প্রবীণ পুরুষের বয়স ১১১ বছর। তিনি ইংল্যান্ডের নাগরিক জন আলফ্রেড টিনিসউড। চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি যাবতীয় রেকর্ড নথিবদ্ধকারী সংস্থা গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড তাকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু সবকিছু ঠিক থাকলে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রবীণ পুরুষ হিসেবে রেকর্ডের জন্য গিনেস কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনের কথা জানায় প্রশাসন। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ-ত্রিপুরা সীমান্তে গ্রাম মেকানিছড়া। পাহাড়ি ওই গ্রামে বাস করেন রাম সিং গড়। দেখা হয় তার সঙ্গে। চা বাগানের তৈরি পাকাঘরে সন্তান ও নাতিপুতির সঙ্গে বসবাস করেন তিনি। বয়সের ভারে দুর্বল হলেও অন্যের সাহায্য ছাড়াই চলাফেরা করতে পারেন তিনি। বাড়িতে টুকটাক কাজও করেন। চশমা ছাড়া পড়তে পারেন লেখা। তিনি তার জাতীয় পরিচয়পত্র দেখান, বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার জন্ম ১৯০৫ সালের ৬ আগস্ট।
তবে তিনি দাবি করেন, জাতীয় পরিচয়পত্রে দেয়া জন্ম সালের চেয়ে বেশি বয়স হতে পারে তার। রাম সিং গড় জানান, ২০০ বছর আগে দাদা শাম্মি গড় নানা হালকু গড়ের সঙ্গে তার বাবা বুগুরাম গড় ভারতে মধ্যপ্রদেশের জবলপুর থেকে চা-শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশে আসেন। এখানে আসার পর তার বাবা বিয়ে করেন। তাদের হাত ধরে শুরু হয় এ দেশে চা চাষ। তার দাদা ও বাবার হাতে শ্রীমঙ্গলের পুটিয়াছড়া চা বাগানের সৃষ্টি হয়। তিনি (রাম সিং গড়) নিজ হাতে জঙ্গল কেটে তৈরি করেন হরিণছড়া চা বাগান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর পর বিয়ে করেন তিনি। প্রথম স্ত্রীর ঘরে এক মেয়েসন্তান ছিল। কয়েক বছর আগে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান তিনি। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন তিনি। সেই স্ত্রীর ঘরে পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে ৮০ বছর বয়সে মারা যান কয়েক বছর আগে। তিনি আরও জানান, যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয় ১৯১৪-১৮ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি তখন চা বাগানের চৌকিদার। ইংরেজ সাহেবদের কাছে এই যুদ্ধের কথা শোনেন। আকাশে প্লেনের উড়াউড়ি দেখেন। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ সব ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে তার। ইংরেজ সাহেবদের সঙ্গে তার অনেক স্মৃতি রয়েছে। তাদের সঙ্গে অনেক বিষয় নিয়ে গল্প হতো। সেগুলো স্পষ্ট মনে আছে তার। তিনি শ্রীমঙ্গলের প্রাচীন বিদ্যাপীঠ ভিক্টোরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। তখন ভিক্টোরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের একপাশে পাকাঘর, লোহার পিলার ছিল, আর একপাশে ছিল ছনের ঘর। তখন তিনি মৌলভীবাজার সড়কের কোনও এক হিন্দু পরিবারের কাছে পড়ালেখা করতেন। এ সময় শ্রীমঙ্গলে কোনও পাকা সড়ক ছিল না।
পাকাঘর বলতে ছিল শ্রীমঙ্গল পুরাতন বাজারে ত্রিপুরা রাজ্য ব্যাংক, রামরতন বানিয়ার বাসা ও জগন্নাথ জিউর আখড়ার পশ্চিমে ত্রিপুরা রাজার বাংলো (রাজ কাচারি) ছিল। মাঝেমধ্যে ত্রিপুরা রাজা হাতির পিঠে চড়ে এই বাংলোয় এসে থাকতেন এবং এখান থেকে খাজনা আদায় করতেন। চা বাগানের তখন নিজস্ব ট্রলি দিয়ে পাতা পরিবহন করা হতো। সেই ট্রলি লাইন স্থাপনও তিনি দেখেছেন। স্থানীয়রা জানান, রাম সিং গড়ের বয়সী মানুষ বহু আগেই মারা গিয়েছেন। কয়েক প্রজন্ম পার করে তিনি এখনও বেঁচে আছেন। বর্তমানে তার সংসারে চতুর্থ প্রজন্ম রয়েছে। তারাও বড় হয়ে গেছে। এলাকাবাসীর দাবি, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রবীণ পুরুষ তিনি। রেকর্ডের জন্য গিনেস কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানানো প্রয়োজন। প্রতিবেশী ৮০ বছর বয়সের সরস্বতী গড় জানান, তিনি যখন একেবারে ছোট ছিলেন রাম সিং গড়ের ছেলেমেয়েরা তখন বিবাহিত। সেই ছোটবেলায় যেমন দেখেছেন তাকে, প্রায় তেমনি আছেন তিনি। অনেকটা সুস্থ সবল। পায়ে হেঁটে এখনও চা বাগানের বাজারে যাতায়াত করেন। রাম সিংয়ের বয়স নিয়ে অনেকের মধ্যেই কৌতূহল দেখা দিয়েছে। ছোটবেলায় তিনি পুরানবাজারে ত্রিপুরা রাজ্য ব্যাংকের ভগ্নাংশ দেখেছেন। আর শ্রীমঙ্গল ভিক্টোরিয়া উচ্চবিদ্যালয় ১৯২৪ সালে স্থাপিত হয়। আর প্রাথমিক শাখা স্থাপিত হয়েছে তারও অনেক আগে।
গিনেস বুকে তার নাম পাঠানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন ডাক্তারি পরীক্ষা করানো উচিত বলে জানান সরস্বতী গড়। শ্রীমঙ্গলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু তালেব বলেন, ‘এরই মধ্যে রাম সিং গড়ের বাড়ি পরিদর্শন করেছি। আমি সমাজসেবা অফিসারকে দিয়ে ওনার তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করাব। সবকিছু ঠিক থাকলে আমরা জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে গিনেস বুক অব রেকর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করব।’ শ্রীমঙ্গল উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. সোয়েব চৌধুরী বলেন, রাম সিং গড়ের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। তবে ভোটার আইডি কার্ডে জন্ম তারিখ রয়েছে। সেসব বিষয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে। গিনেস বুকে আবেদন করতে গেলে অনেক তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন।