ঢাকা ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুসংবাদ প্রতিদিন

নারীদের তৈরি পাটের পণ্য যাচ্ছে ইউরোপে

নারীদের তৈরি পাটের পণ্য যাচ্ছে ইউরোপে

দেশের সোনালি আঁশ তথা পাট দিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা পণ্য। নারীদের নিপুণ হাতে তৈরি এসব পণ্য দেশ ছেড়ে রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপের দেশগুলোতে। মেধা, শ্রম আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার ভবরপাড়া গ্রামের বেশ কিছু নারী উদ্যোক্তার জীবনে এনে দিয়েছে সফলতা। এসব উদ্যোক্তাদের মধ্যে কেউ বিধবা, কেউ অতি দরিদ্র আবার কারো সংসারে নেই কোন উপার্জনক্ষম মানুষ। সংসারের দৈনন্দিন কাজ শেষ করে সোনালি আঁশ নিয়ে বসে পড়েন সৌখিন পণ্য তৈরির কাজে। মাদুর, ম্যাট, ফুলদানি, টেবিল ম্যাট, দোলনা, খেলনা মাছ, ক্রিসমাসের তারকা, ব্যাগসহ নানা ধরণের সৌখিন পণ্য তৈরি করেন তারা। তাদের হাতে তৈরি এসব পণ্য অর্থনীতির চাকাকেও সচল রাখতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৪-১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে- একেকটি পণ্য। বিভিন্ন এনজিওভিত্তিক রপ্তানিকারকরা তাদের পাটের তৈরি পণ্য কিনে নিয়ে রপ্তানি করছেন ইউরোপের স্পেন, ইতালি, জার্মানী, সুইডেন, ফিনল্যান্ডসহ আমেরিকার বিভিন্ন বাজারে। তাদের এ কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া, বিক্রির বাজার খোঁজা, বিপণন, যোগাযোগসহ সকল প্রকার সহায়তা প্রদান করে মুজিবনগর উপজেলার ভবরপাড়া মিশনারী কর্তৃপক্ষ। কমপক্ষে অর্ধশত নারী এসব শৌখিন পণ্য তৈরির কাজে যুক্ত রয়েছেন। সংসারের অভাব দূর করার পাশাপাশি নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তনও ঘটেছে এসব নারীদের। স্বাধীনতার ইতিহাসে স্মরণীয় নাম মুজিবনগর।

মুজিবনগর উপজেলার খ্রিষ্টান অধ্যুষিত একটি গ্রামের নাম ভবরপাড়া। এ গ্রামের নারী উদ্যোক্তা সন্ধ্যামনি জানান, সংসারে আয় রোজগার করার লোক না থাকায় চরম দারিদ্র্যতার মধ্য দিয়ে তাদের দিন কাটছিল। এ সময় তাদের গ্রামের মিশনারী (চার্চ) থেকে হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ নিয়ে পাটের সৌখিন পণ্য তৈরির কাজ শুরু করেন। প্রথম প্রথম দ্রুত কাজ করতে না পারা এবং নিখুঁতভাবে পণ্য তৈরি করতে না পারায় আয় রোজগার কম হত। এখন দ্রুত ও সুন্দরভাবে কাজ করতে পারায় আয় রোজগার ভালো হচ্ছে। বিদেশে ব্যাপক চাহিদা থাকায় এলাকার অসহায় ও দরিদ্র নারীরা দিন দিন এ কাজে আগ্রহী হয়ে উঠছে। চাহিদা অনুযায়ী পণ্য তৈরি করে সময়মতো সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। অনেক নতুন নতুন নারী কাজ শিখে যোগ দিচ্ছেন তাদের সাথে।

আফরোজা খাতুন জানান, মেহেরপুরের পাট সাধারণত কালো রঙের হয়। ফলে মেহেরপুরের পাট দিয়ে কাজ করলে তা আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন হয় না। রপ্তানিযোগ্য পাটপণ্য তৈরির জন্য ফরিদপুর থেকে পাট কিনে আনতে হয়। ফরিদপুরের পাট সোনার মতো চিক চিক করে। তাতে খরচ বেশি হয়ে যায়। সাশ্রয়ী মূল্যে পাট পেলে আরো বেশি লাভবান হতে পারতেন তারা।

মালা রানী জানান, তাদের নিপুণ হাতের তৈরি পাটপণ্য বিদেশে রপ্তানী হচ্ছে। মাঝেমাঝে বিদেশিরা পণ্য দেখতে এসে তাদের প্রসংশা করে। এতে তাদের খুব ভালো লাগে। এখন তাদের আর কারো মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে হয় না। গত বছর ইতালী, স্পেন ও আমেরকিা থেকে লোক এসে তাদের কাজ দেখে গেছে। তারা আরো বেশি পরিমাণে এসব সৌখিন পণ্য কেনার আগ্রহ দেখিয়েছেন। উদ্যোক্তা প্রধান কণা রানী জানান, সেই ২০১৭ সালে প্রথম ৫ জন নারীকে নিয়ে পাটের সৌখিন পণ্য তৈরির কাজ শুরু করেন। এখন প্রায় ৫০ জন নারী এ কাজের সাথে যুক্ত রয়েছেন। তবে এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রথমে স্পেনে তাদের পণ্য রপ্তানী করা হত। এখন স্পেন ছাড়াও ইতালী, জার্মানী, নরওয়ে, সুইডেন ও আমেরিকায় রপ্তানী হচ্ছে। এখন চাহিদা বাড়ায় সংসারের কাজ সেরে সকাল-সন্ধ্যা সবসময় কাজে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে তাদের। ইচ্ছে করলে একেকজন নারী প্রতিদিন ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারে। নারীরা এ কাজে এগিয়ে আসলে তাদের বিদেশ যাবার দরকার নেই। এখন অর্ডার করলেই ফরিদপুর থেকে পাট পাঠিয়ে দেয়। অর্ডার অনুযায়ী পণ্য তৈরি করে সাথে সাথে ডেলিভারি দিয়ে দিই। ক্রেতারা নিজেরাই এসে পণ্য নিয়ে যান। তাদের কোনো যায়গায় যেতে হয় না। সততা, ন্যায়, নিষ্ঠা ও কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারলে ঘরে বসেই জীবন ধারণের জন্য যা প্রয়োজন তা উপার্জন করা সম্ভব। তাদের সাথে কর্মরত নারীদের প্রসংশা এখন সারা ইউরোপজুড়ে। ইউরোপে পাটপণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বেইজ বাংলাদেশের পরিচালক সৌরভ আনছারী বলেন, তারা গ্রামীণ নারীদের হস্তশিল্প সামগ্রী বিদেশে রপ্তানি করার সুযোগ করে দিচ্ছেন। তাদের লক্ষ্য গ্রামীণ দরিদ্র অসহায় নারীদের স্বনির্ভর করে গড়ে তোলা। তারা যেন এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে। পাটের পণ্য তৈরি, বিপণন সহ সকল কাজে তারা সহযোগিতা করে আসছেন।

জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নীলা হাফিয়া জানান, মেহেরপুরে কোন শিল্প-কলকারখানা না থাকায় দরিদ্র ও অসহায় নারীদের শ্রমিকের কাজ করতে হয়। পুরুষদের সাথে ক্ষেতে-খামারে দিনমজুরের কাজ করেন। অনেকে তামাক কোম্পানীতে তামাক বাছাইয়ের কাজ করেন। এ ধরণের কঠোর পরিশ্রম থেকে উত্তোরণের লক্ষ্যে এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বি করে গড়ে তোলার জন্য তারা বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন। সাথে সাথে পুঁজির জন্য ঋণের ব্যবস্থাও করে থাকেন। ভবরপাড়া গ্রামের নারীদের নিপুণ হাতে পাটের তৈরি পণ্য দেখে মুগ্ধ তিনি। এসব পণ্য যারা দেখবে তাদেরই কিনতে ইচ্ছে করবে। মুজিবনগরের নারীরা এখন ঘরে বসেই বিশ্বমানের পাটের পণ্য তৈরি করছেন যা রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। এটা সম্মানের এবং গৌরবের বিষয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত