ঢাকা ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুসংবাদ প্রতিদিন

মধুপুরের আনারস পাতায় তৈরি তৈজসপত্র যাচ্ছে বিদেশে

মধুপুরের আনারস পাতায় তৈরি তৈজসপত্র যাচ্ছে বিদেশে

রসে ভরপুর ও নানা পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ টাঙ্গাইলের মধুপুর অঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে স্বীকৃত। সম্প্রতি এ ফলটি জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) পণ্য হিসেবে অনুমোদন লাভ করেছে। এসব গাছের পাতা থেকে তৈরি হস্তশিল্প দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। আগে আনারস ফল কাটার পর এসব গাছের পাতা ফেলে দেয়া হত। কেউ কেউ আবার এসব পাতা গো-খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করত। বর্তমানে আনারসের এ ফেলনা পাতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের সৌখিন তৈজসপত্র। এতে মিলছে বাড়তি অর্থকড়িও। ক্রমে এসব হস্তশিল্পের উৎপাদন ও ব্যবহারের প্রসার ঘটছে। টাঙ্গাইলের মধুপুরের পাহাড়ি এ জনপদের নৃতাত্ত্বিক নারীরা প্রথমে স্বউদ্যোগে ঘর-গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহৃত হয়, এমন কিছু সৌখিন হস্তশিল্প তৈরির উদ্যোগ নেন। পরে মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি বাংলাদেশ নামের একটি বিদেশি সংস্থা ২০০৮ সালে আনারসের পাতা থেকে সুতা উৎপাদনে হাত দেন। অরনখোলা ইউনিয়নের জলছত্র বাজারে এ প্রতিষ্ঠানের অবস্থান। এরপর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্যুরো বাংলাদেশ ২০১৭ সালে বেরীবাইদ ইউনিয়নের জাঙ্গালিয়া গ্রামে আনারস পাতা থেকে তৈরি সুতা দিয়ে বিভিন্ন হস্তশিল্প তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে শতাধিক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি পরিত্যক্ত আনারস পাতা বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে চাষিরাও।

?ফাইবার এক্সট্রাকশন মেশিনের মাধ্যমে আনারস পাতা থেকে আঁশ বের করা হয়। তারপর ভাঙা প্লেট ও নারিকেলের খোসা দিয়ে ঘষে পাতা থেকে আঁশ বের করে পানিতে ধুয়ে নেয়া হয়। এরপর সেগুলো রোদে শুকাতে হয়। এক কেজি পাতা থেকে ৬০ সেন্টিমিটার লম্বা শক্ত সুতা পাওয়া যায়। আঁশ বের করার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় ৩০ জন মানুষের সংস্পর্শ লাগে। ১০০০ কেজি পাতা থেকে ১০০-১৫০ কেজি আঁশ পাওয়া যায়। এ সুতার বিভিন্নমুখী ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে সুতাগুলো হাতে রশি পাকিয়ে হস্তশিল্প ও গৃহসজ্জার নানান রকম জিনিসপত্র বানানো যায়। এ ছাড়া সুতা থেকে উন্নতমানের কাপড়ও বানানো যায়। আশার বিষয় হলো, আনারস পাতা থেকে উৎপাদিত সুতা দিয়ে উন্নতমানের লেদার বানানোর কাজে এটি দেশের বাইরে রপ্তানি করা হচ্ছে।

আবার যেসব পাতা থেকে সুতা তৈরি করা যায় না, সেগুলো থেকে জুয়েলারি বক্স, টেবিল ম্যাট, ফ্লোর ম্যাট, ফ্লাওয়ার বক্স, ওয়াল হ্যাঙ্গিং, চাবির রিংসহ নানান পণ্য বানানো হয়। আকর্ষণীয় এসব পণ্য যাচ্ছে চীনসহ উন্নত দেশগুলোতে। এখানে কাজ করে অনেক নারীই হয়ে উঠছেন স্বাবলম্বী। আগে যেসব নারী বনে ও আনারসের জমিতে কাজ করে যে টাকা পেত, তার চেয়ে বেশি টাকা পাচ্ছেন এ হস্তশিল্পের কাজ করে। ফলে সংসারের অভাব মিটিয়ে তারা এখন অনেকটা সচ্ছল জীবনযাপন করছেন। কথা হয় উপজেলার বেরীবাইদ গ্রামের ফিরোজ মিয়ার সঙ্গে। তিনি এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছেন। এ শ্রমিক জানান, আনারসের পাতা থেকে এত সুন্দর পণ্য তৈরি হতে পারে তা আগে জানতাম না। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সব জানতে পেরেছি। তার মতো আরো অনেক শ্রমিক এখানে কাজ করছেন। তারা আনারস চাষের পাশাপাশি বাড়তি উপার্জন করতে পার্টটাইম কাজ করছেন।

আনারস চাষি রাজ্জাক মিয়া বলেন, একটি পরিপূর্ণ আনারস গাছে ৩৬টি পাতা হয়। একটি গাছে একবারই ফল ধরে। ওই গাছের গোড়ায় নতুন গাছ জন্মায়। আনারস কাটার পর ওই গাছের অন্তত ১৫-২০টি পাতা কেটে ফেলা হয়। আর নতুন গাছ হওয়ার পর সব পাতাই কাটা যায়। এই পাতাগুলো নিচে পড়ে নষ্ট হয়। মাটিতেই পচে মিশে যায়। কেউ কেউ গবাদিপশুর জন্যও নিয়ে যান। কিন্তু কয়েক বছর ধরে আমরা বিক্রি করছি। আনারস বিক্রির টাকার পাশাপাশি বাড়তি টাকা পাচ্ছি পাতা বিক্রি করে।

ব্যুরো বাংলাদেশের হস্তশিল্পের কারখানার এজিএম আমীর হামজা বলেন, নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন শৌখিন জিনিসপত্র তৈরি করা হচ্ছে। এতে তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। আগে যারা বন, আনারস বাগানে কাজ করতেন সেসব নারী আমাদের এখানে কাজ করছেন। এখানে নারী-পুরুষ মিলে ৭০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। এর মধ্যে অধিকাংশ নারী আছে। যারা সুবিধাবঞ্চিত নারী। স্বামী পরিত্যক্তা নারীরাই এখানে বেশি কাজ করেন। এখানে প্রায় ৪০০ শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের এখানে মজুত আছে অনেক পণ্য, সে কারণে এখন আমরা উৎপাদন আপাতত কমিয়ে দিয়েছি। তবে আমরা একটি কম্পমেস কারখানা তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছি।’ এ উপজেলায় বিভিন্ন স্থানের বাগানগুলো যদি সরকারের পক্ষে আমাদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে তাহলে উৎপাদিত পণ্য গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করা যেত বলে জানান এ কর্মকর্তা।

স্থানীয় শ্রমিক শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের প্রশিক্ষণের সময় দুই থেকে তিন মাস সময় লাগায় তারা তেমনটি আগ্রহ প্রকাশ করে না এ কাজে। এজন্য শ্রমিকদের শিক্ষানবিশকালীন তাদের ভাতা বা প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকলে তারা আগ্রহী হয়ে উঠবে এ পেশায়।

নারী উদ্যোক্তা ও ব্যুরো ক্রাফটের পরিচালক রাহেলা জাকির বলেন, ‘এ উপজেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস বেশি। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া এই মানুষদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে মধুপুরে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।’ এ উদ্যোক্তা আরও জানান, চীনের একটি মেলায় তারা অংশগ্রহণ করে এসব পণ্যের বেশ সাড়া পেয়েছেন। এ ছাড়া আরও অনেক দেশই হস্তশিল্পের এ পণ্যের প্রতি আগ্রহের কথা জানিয়েছে। আনারসের কিছু পাতা আছে যেগুলো দিয়ে আঁশ বানানো সম্ভব হয় না সেগুলো দিয়ে আমরা টিস্যু পেপার তৈরি করছি। অর্থাৎ আনারসের কোনো জিনিসই আর ফেলনা নয়। তাদের ওয়ান টাইম প্লেট ও গ্লাস তৈরির পরিকল্পনা চলছে। পরিত্যক্ত প্রাকৃতিক কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পরিবেশবান্ধব এসব পণ্যের দেশের বাইরে চাহিদা রয়েছে বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত