ঢাকা ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পণ্যের দাম লাগামছাড়া

পণ্যের দাম লাগামছাড়া

বাজারে নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও খুব বেশি কাজে আসছে না। বরংচো প্রতি সপ্তাহেই রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে- ডিম, মাছ, মুরগি, সবজির দাম। দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে সিন্ডিকেটকেই দুষছেন ক্রেতা ও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা।

শুক্রবার রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে প্রায় সব ধরনের সবজির দামই কমবেশি বেড়েছে। অধিকাংশ সবজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার কাছাকাছি। এছাড়া কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, বিভিন্ন ধরনের মাছ, ব্রয়লার মুরগি ও ফার্মের মুরগির ডিমের দামও আগের তুলনায় বেশি। বাজারভেদে করলা, ঝিঙা, ধুন্দুল, চিচিঙ্গা, পটোল, ঢ্যাঁড়স ৮০-১০০ টাকায়; কাঁকরোল ১০০-১২০ টাকায়; বরবটি ১৩০-১৪০ টাকায়, ধরনভেদে বেগুন ১০০-১৬০ টাকায় ও টমেটো ২৬০-২৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সবজির মধ্যে ৫০ টাকার নিচে দাম রয়েছে পেঁপের, কেজি ৪০ টাকা। এদিকে দুই সপ্তাহ আগেও বাজারে ১৮০-২২০ টাকা কেজি দরে কাঁচা মরিচ কেনা যেত। গতকাল খুচরা বাজারে সর্বোচ্চ ৩২০-৩৫০ টাকায় মরিচ বিক্রি হয়েছে।

মাঝখানে মরিচের দাম ৫০০ টাকাও ছুঁয়েছিল। বাজারে ধনেপাতার দামও চড়া; প্রতি কেজি ৪০০-৫০০ টাকা। এ ছাড়া কলমিশাক, লালশাক, ডাঁটাশাক, পুঁইসহ বিভিন্ন শাকের দামও (মুঠি) ১০-১৫ টাকা করে বেড়েছে। মসলা পণ্যের মধ্যে পেঁয়াজের দাম কেজিতে পাঁচ টাকা বেড়েছে। গতকাল খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ১২০-১২৫ টাকায় ও আমদানি করা পেঁয়াজ ১০০-১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া আদা, রসুন ও আলুর দাম আগের মতোই রয়েছে।

বিক্রেতারা জানান, বাজারে সবজির চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে। আর হঠাৎ করে সবজি, ডিম ও মুরগির দাম বেড়ে যাওয়ায় অস্বস্তিতে পড়েছেন গ্রাহকরা। রাজধানীর শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও তালতলা, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও নিউমার্কেট কাঁচাবাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে ঢুকতেই সবজির বাড়তি দামের আঁচ পাওয়া গেল। দাম নিয়ে এক সবজি বিক্রেতার সঙ্গে তর্কে জড়ান স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল করিম। তিনি সেখান থেকে ১৪০ টাকা দরে আধা কেজি বরবটি ও ১৫০ টাকা দরে এক কেজি বেগুন কিনেছেন। নুরুল করিম বলেন, এক সপ্তাহ আগেই বেগুন ও বরবটির দাম ১০০ টাকার আশপাশে ছিল।

অন্তর্বর্তী সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে গত ১৬ সেপ্টেম্বর ডিম ও মুরগির দাম বেঁধে দিয়েছিল। সে হিসেবে প্রতি হালি ডিমের দাম পড়ে ৪৮ টাকা। ব্রয়লার মুরগির দাম নির্ধারণ করা হয় খুচরায় ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা ও সোনালি প্রতি কেজি ২৬৯ টাকা ৬৪ পয়সা। কিন্তু সরকারের নির্ধারণ করা দামে তিনটি পণ্যের কোনোটিই মিলছে না বাজারে। বাজারভেদে ব্রয়লার মুরগি ২০০ থেকে ২১০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায়।

গতকাল রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ওয়ার্ল্ডস পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ শাখা ও বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের উদ্যোগে বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, ব্যবসায়ীরা দাবি করছিলেন ডিমের সংকট আছে। আমদানির খবরে ডিমের দাম কিছুটা কমে গেলো। তাহলে বোঝা যায় ডিমের দাম বৃদ্ধি সেটা কারসাজি। কোনো ধরনের কারসাজি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

ফরিদা আখতার বলেন, ডিম সহজলভ্যতার দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ডিম প্রাপ্যতার কোনো বৈষম্য থাকবে না। সব শ্রেণি-বর্ণ নির্বিশেষে, যাদের ডিম বেশি দরকার তাদের জন্য তা সরবরাহ করতে হবে।

ডিমের উৎপাদন বাড়াতে গ্রামীণ নারীদের হাঁস-মুরগি পালনে উৎসাহিত করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগে গ্রামীণ নারীরা হাঁস-মুরগি পালন করতেন। নিজেরা গ্রামেই পাইকারদের কাছে বিক্রি করতেন। এতে তারা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারতেন। সেই অবস্থা আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সময় মিডিয়ার কারণেও ডিমের দাম বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, মিডিয়ায় এমনভাবে লেখা হয় তাতে বাজার অস্থির হয়ে যায়। আমরা ভোক্তারাও অস্থির হয়ে পড়ি।

ফরিদা আখতার আরো বলেন, কিছু মৌসুমে প্রাকৃতিক কারণেও ডিমের উৎপাদন কমে যায়। রমজানে ডিমের ব্যবহার কমে যায়। তাই মজুত নয়, চাহিদার আলোকে কোল্ডস্টোরেজ করার চিন্তা করতে হবে। এছাড়া ডিমকে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের সবজি বিক্রেতা আব্বাস আকন্দ বলেন, বাজারে সজির দাম বেশি হওয়ায় আগের তুলনায় কম করে সবজি কিনছেন মানুষ। আর বিক্রি যত কম হয়, আমাদের লাভের পরিমাণও কমে যায়।

বাজারের আরেক ব্যবসায়ী মো. বেলাল বলেন, দেশজুড়ে বৃষ্টি ও বন্যায় নতুন করে ফসল লাগানো যাচ্ছে না। বাজারে এখন সবজির দাম বাড়ার পেছনে বন্যা অন্যতম কারণ। কুমিল্লা, নোয়াখালী অঞ্চলে বন্যায় সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। সেখানেও এখন ঢাকা থেকে সবজি যাচ্ছে। এর প্রভাব ঢাকার বাজারে পড়েছে। আবার নতুন করে উত্তরাঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে। সেখানেও সবজি চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

সারাদেশে শাকসবজির দাম বাড়ার পাশাপাশি ডিমের দামও বেড়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বাৎসরিক তথ্যানুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ডিমের চাহিদা ছিল ১ হাজার ৮০৯ কোটি ৬০ লাখ পিস। বিপরীতে উৎপাদন হয় ২ হাজার ৩৭৪ কোটি ৯৭ লাখ। উদ্বৃত্ত থাকে ৫৬৫ কোটি ৩৭ লাখ পিস ডিম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে চাহিদা ছিল ১ হাজার ৮০৬ কোটি ৪৮ লাখ, উৎপাদন হয়েছে ২ হাজার ৩৩৭ কোটি ৬৩ লাখ পিস। সে হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৫৩১ কোটি ১৫ লাখ পিস।

বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে ডিমের সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। অর্থাৎ বাজারে ডিমের যে চাহিদা রয়েছে, তার চেয়ে কম ডিম বাজারে আসছে। মূলত এ কারণেই দাম বেড়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. বাপন দে বলেন, আসলে চাহিদা উৎপাদনের পরিষ্কার তথ্য থাকা দরকার। সেটা না হলে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সম্ভব না। ডিমসহ অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে তা নেই। আবার আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক না। ছয়-সাতবার ডিম হাতবদল হচ্ছে। আর প্রতিজনই লাভ নিচ্ছেন। ফলে উৎপাদনকারী কম লাভ পাচ্ছেন, কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে দাম বেড়ে যাচ্ছে। এজন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে বাজার মনিটরিং জোরদার করা প্রয়োজন।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, বাজারে মাছ, সবজির সরবরাহ কম, দামও চড়া। এ কারণে ডিমের ওপর একটা বাড়তি চাপ বেড়েছে, বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে। আমাদের ডিমের উৎপাদন এখনো চাহিদার চেয়ে বেশি, যে কারণে আমরা আমদানি না করার বিষয়ে মত দিয়েছিলাম। তবে আমাদের ডিমের উৎপাদন আরও এক কোটি পিস বাড়ানো দরকার।

প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, বন্যায় হাজার হাজার খামার একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে ডিমের সরবরাহ কমেছে। কিন্তু এ সময় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ডিমের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে বলে বাজারে অস্থিরতা। তাদের সুবিধা দিতে সরকার এখনো এ খাতে উৎপাদন কমার বিষয়টি গোপন করছে। তারপরও আমদানি করে করে সবার ক্ষতি না করে সরকারের উচিত করপোরেট কোম্পানিগুলোকে ধরা এবং ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের পুনরায় উৎপাদনে ফিরিয়ে আনা।

নিত্যপণ্য দামের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই গতকাল শনিবার রাজধানীর মিরপুরে শাহ্আলী সিটি কর্পোরেশন মার্কেট ও শনিরআখড়া সবজির বাজারে তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের টিম। নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা ঠেকাতে পৃথক দুই টিম বাজারে এ তদারকি করে। এসময় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৪ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়। শাহ্আলী সিটি কর্পোরেশন মার্কেট বাজার তদারকি টিমের নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মোছা. ফুয়ারা খাতুন। এ সময় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে চাল, ডাল, আলু, ডিম, সবজি ও মুরগির বাজারে তদারকি করা হয়। টিমের সদস্যরা মূল্য তালিকা হালনাগাদ করাসহ সব পণ্য ক্রয়ের ও বিক্রয়ের রশিদ যাচাই করেন। এসময় মূল্য তালিকা সঠিকভাবে না টানানো, যথাযথভাবে না লেখা ও সংরক্ষণ না করায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করার পাশাপাশি ১ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়।

এদিকে গত কয়েক দিনের তুলনায় ডিমের দাম হালি প্রতি ৫ টাকা কমেছে বলে দোকান মালিক ও ভোক্তারা তদারকি টিমকে জানিয়েছেন। অপরদিকে রাজধানীর শনিরআখড়া সবজির বাজারে ডিম, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, মুরগি ও চালসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্রয়মূল্য ও বিক্রি মূল্য যাচাই করা হয়। এ সময় মূল্য তালিকা টানাতে দোকানিদের তাগিদ দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত