বরেন্দ্র অঞ্চল উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁ। ধান-চালের জেলা হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে আমের জেলা হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। আমের পাশাপাশি উদ্যোক্তারা এখন বিভিন্ন ফল চাষের দিকে আগ্রহী হচ্ছে। তার মধ্যে ড্রাগন ফল অন্যতম। এ জেলার মাটি এঁটেল ও বেলে দোঁআশ হওয়ায় ফল সুস্বাদু ও সুমিষ্ট হয়। কম পরিশ্রমে বেশি লাভজনক হওয়ায় জেলায় দিন দিন বাড়ছে ড্রাগন ফলের চাষ।
স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এখন দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হচ্ছে। তবে কৃষি বিভাগের পরামর্শ এবং সার্বিক সহযোগিতা পেলে আগামীতে ড্রাগন ফল দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানির সম্ভব।
কৃষি অফিসের তথ্যমতে- চলতি বছর জেলায় প্রায় ১০০ হেক্টর জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ হয়েছে। আর এর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৮০০ টন। যার বাজারমূল্য ১৫০ টাকা কেজি হিসেবে প্রায় ১২ কোটি টাকা। জানা গেছে, পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ড্রাগন ফল। এ ফল চাষাবাদে কম পরিশ্রমে বেশি মুনাফা অর্জন করা যায়। রোপণের এক বছরের মাথায় গাছে ফুল আসা শুরু করে। ফুল আসার ২৫-৩০ দিনের মধ্যে ফলে পরিণত হয়। প্রতিটি ফলের ওজন ২০০-৩০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। সব ধরনের মাটিতে এ ফলের চাষ হয়ে থাকে। বছরে ৭-৮ মাস ফল পাওয়া যায়। বাগানে প্রায় পাঁচ ফুট উচ্চতায় কংক্রিটের খুঁটির ওপর টায়ার পেঁচিয়ে ও রড পদ্ধতি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে ড্রাগন ফলের গাছ।
প্রতিটি গাছে ১৫-২০টি ফুল ধরেছে। ফুল থেকে ৪-৫টি করে কাঁচা, আধাপাকা ও পাকা ফল ঝুঁলে আছে। পাঁকা ফলে পুরো বাগান প্রায় রক্তিম। প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চাষ হওয়ায় খেতেও সুস্বাদু। বিদেশি ফলের চাহিদা কমাতে দেশেই এখন বিভিন্ন ফলের উৎপাদন হচ্ছে। চাহিদা থাকায় ব্যবসায়িরা বাগান থেকে এ ফল সংগ্রহ করছে। তবে আগামীতে ড্রাগন ফল দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি সম্ভব। শিক্ষক হাফেজ মাহবুবুর রহমান। বাড়ি নওগাঁ শহরের সিও অফিস এলাকায়। তবে জেলার মহাদেবপুর উপজেলার মধুপুর গ্রামের বাড়িতে গত ৪ বছর আগে দেড় বিঘা জমিতে ‘রেড মরককান’ জাতের ড্রাগন ফলের বাগান গড়ে তুলেন। সে সময় দাম ভালো থাকায় খরচ বাদে প্রায় ৪ লাখ টাকা আয় করেন। পরবর্তীতে পরিধি বাড়িয়ে মোট ৬ বিঘাতে এ ফলের বাগান করেন।
মাহবুবুর রহমান বলেন- ছাত্র জীবন থেকেই গাছপ্রেমি। জেলায় তার হাত ধরেই ড্রাগনের চাষ শুরু বলে দাবি করেন। ২০১১ সালে ক্ষুদ্র পরিসরে ড্রাগন চাষ শুরু করেন। পরবর্তীতে ২০২০ সালে বাণিজ্যিক পরিসরে চাষ শুরু করেন। শুরুতে প্রায় ৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। রোপণের ৮ মাস পর অল্প পরিমাণ ফল আসা শুরু হয়। দ্বিতীয় বছর সাড়ে ৬ লাখ টাকা আয় এবং ১ লাখ টাকা ব্যয় হয়। লাভজনক হওয়ায় পরের বছর বাগানের পরিধি বাড়ানো হয়। এতে ২ লাখ খরচ হলেও লাভ হয় সাড়ে ৮ লাখ টাকা। ২০২৩ সালে মোট ৬ বিঘা জমিতে বাগান গড়ে তোলা হয়। মৌসুমের শুরুতে ২২০-২৩০ টাকা কেজি পাইকারি দরে বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে ১৫০ টাকা কেজি। চলতি বছর প্রায় ৮ লাখ টাকার ফল বিক্রি হয়েছে। আরো প্রায় ৩-৪ লাখ টাকা আসবে। ড্রাগন চাষ লাভজনক বলে জানান তিনি।
নওগাঁ সদর উপজেলার মখরপুর গ্রামের উদ্যোক্তা সাদেকুল ইসলাম বলেন, এক বিঘা জমিতে ড্রাগনের বাগান করেছেন। ১০ কাঠা দিয়ে শুরু করলেও লাভজনক হওয়ায় পরবর্তীতে আরো ১০ কাঠায় বাগান করেছেন। আমাকে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন হাফেজ মাহবুবুর রহমান ভাই। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে এ ফলের চাষ করা হয়। স্থানীয় বাজারে এ ফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ১২-১৫ দিন পর পর ড্রাগন ফল সংগ্রহ করা হয়। প্রতি চালানে প্রায় ৩-৪ মণ সংগ্রহ হয়। বাগান থেকেই এলাকাবাসীরা কিনে নিয়ে যায়। বাজারে বিক্রির জন্য যাওয়ার দরকরা হয়। এলাকার যুবকরা এসে পরামর্শ নিয়ে যায় কীভাবে চাষ করতে হবে। তিনি বলেন- অনেকেই অল্প সময়ে বেশি লাভের আশায় এ ফলে ক্ষতিকর হরমোন বা টনিক ব্যবহার করে। যা শরীরর জন্য খুবই ক্ষতিকর।
কৃষক আরিফুল বলেন- বাজারে বিদেশি যেসব ফল রয়েছে সেগুলো ৩০০ টাকার ওপরে। দাম বেশি হওয়ায় সবার পক্ষে ফল কেনা সম্ভব হয় না। তবে ড্রাগন ফলের দাম সাধ্যের মধ্যে হওয়ায় সবাই কিনে খেতে পারছে। এ ফলটি খুবই সুস্বাদু। ড্রাগন বাগান হওয়ায় মানুষের কর্মসংস্থান বেড়েছে।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন- আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় দিন দিন বাড়ছে ড্রাগন ফলের চাষ। বিদেশি ফল হলেও এর ফল ভালো। আর ভালো দাম পাওয়ায় লাভবান হচ্ছে কৃষকরা। উচ্চমূল্যে ফসলের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি কারিগরি সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।