রংপুরে দখলে-দূষণে শ্যামাসুন্দরী খাল

প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আব্দুর রহমান মিন্টু, রংপুর

দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত রংপুরের শ্যামাসুন্দরী খাল। খনন ও সংস্কার না করায় ময়লা-আবর্জনায় ভরে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী শ্যামাসুন্দরী খালটি। আবার ১৬ কিলোমিটার এলাকার অনেক স্থানে দখল করছে কিছু প্রভাবশালীরা। এর ফলে আগের সেই শ্যামাসুন্দরীর চিত্র বদলে গেছে। আবার সুন্দরী উপর ময়লা-আবর্জনা ও বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিকের বর্জ্য ফেলার ফলে ভাগারে পরিণত হয়েছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে- রংপুরের ঐতিহ্যবাহী শ্যামাসুন্দরী খাল। ২০২০ সালে ২৬ সেপ্টেম্বর রংপুর নগরীতে ৪৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। রাত থেকে শুরু হওয়া মুষলধারে বৃষ্টিতে রংপুর নগরীর বেশিরভাগ এলাকায় হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্তু পানিতে তলিয়ে যায়। বাড়ি-ঘরে পানি প্রবেশ করায় অন্তত ৮০হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পরে। রংপুর নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নগরীর নিচু এলাকার বেশিরভাগ রাস্তুা ৩-৪ ফুট পানিতে তলিয়ে যায়। পানি প্রবাহ ও শ্যামা সুন্দরী খাল খনন না থাকায় দুভোর্গে পড়তে হয় নগরবাসিকে। শ্যামাসুন্দরী খাল ভরাট ও খনন না করায় একটু পানি হলে জলাশয়ে রুপ নেয়। শত বছরের রেকর্ড বন্যা হয়েছিল রংপুরে। সেই সময় খালটি ভরাট থাকায় বন্যার পানিতে তলিয়েছিল রংপুর নগরী। খালের খনন ও সংস্কার না করার বন্যা আর জলাবদ্ধতার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় ও সিটি কর্পোরেশনবাসী। নগরীর পানি নিষ্কাশন ও সংস্কার না করায় খালটি পরিণত হয়েছে জলাশয়ে। সেই শ্যামাসুন্দী খালটি প্রায় ১৫ দশমিক ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং স্থানভেদে ২৩ থেকে ৯০ ফুট প্রশস্ত এই খাল সিটি এলাকার উত্তর-পশ্চিমে কেল্লাবন্দস্থ ঘাঘট নদী থেকে শুরু হয়ে নগরীর সব পাড়া-মহল্লার বুকচিরে ধাপ পাশারিপাড়া, কেরানীপাড়া, মুন্সীপাড়া, ইঞ্জিনিয়ারপাড়া, গোমন্তাপাড়া, সেনপাড়া, মুলাটোল, তেঁতুলতলা শাপলা চত্বর, নূরপুর, বৈরাগিপাড়া হয়ে মাহিগঞ্জ সাতমাথা রেলগেট এলাকায় কেডি ক্যানেল স্পর্শ করে খোকসা ঘাঘট নদীতে মিশেছে। স্থানীয় মোকলেছুর রহমান বলছেন, অনিয়মে ভেস্তেু গেছে সংস্কারের উদ্যোগও।

পুরো রংপুর শহরজুড়েই ছড়িয়ে আছে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ শ্যামা সুন্দরী খালটি। দীর্ঘদিন খনন ও সংস্কারে অভাবে দুভোগে রংপুর বাসি। তিনি আরো জানান, নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি দেন প্রার্থীরা। কিন্তু নির্বাচনে জয়ের পর শ্যামাসুন্দরী নিয়ে কাজ করেনি মেয়র কিংবা কাউন্সিলরা। তবে মাঝে মাঝে লোক দেখানো ও দায়সারা খনন করা হলেও পরে বন্ধ হয়ে এ কর্মসূচি। ১৮৯০ সালে এই খাল খনন করেন রাজা জনকী বল্লভ সেন। মা-শ্যামাসুন্দরী ম্যালেরিয়ায় মারা যাওয়ার পর মশার উপদ্রব কমাতে পানি নিষ্কাশনের জন্য এই খাল খনন করেছিলেন রাজা। তবে সেই খালটির অনেক জায়গাই এখন মশার প্রজনন ক্ষেত্র। মশার উপদ্রব অনেক বাড়ছে নগরীতে।

ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে পানি প্রবাহ। দখলের কারণের অনেক জায়গায় এর অস্তিত্বই বিলীন। ঐতিহ্যবাহী খালটি সংস্কার ও এর দু-পাশের সৌন্দর্য বাড়াতে ২৫ কোটি টাকা খরচ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। অনিয়মের কারণে পুরোটাই গচ্ছা গেছে দাবি স্থানীদের। স্থানীয় ফারুক হোসেন ও সালাম মিয়া বলেন, রংপুর মহানগরীতে মশার উপদ্রব ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ময়লা-আর্বজনার কারণে মশার উৎপাত বেড়েই চলছে। মশারি ও কয়েল ছাড়া দিনেও ঘরে অবস্থান করা যায় না। দিনের আলো কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে অবস্থান আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। দিন-রাত সমানতালে মশার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পরছি। রংপুর শ্যামা সুন্দরী খাল ও ক্যাডি খাল সংস্কার না করায় মশার উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়েছে। খালের পাশের বাড়ির মালিক আতিফ জানান, রংপুরের শ্যামা সুন্দরী খাল ১৩৬ বছরের পুরাতন। এই খালটি তৎকালীন পৌরসভার চেয়ারম্যান ও ডিমলা রাজা জানকি বল্লভ সেন তার মাতা শ্যামা সুন্দরীর স্মরণে খনন করেছিলেন। ১৮৯০ সালে এই খালটির উদ্বোধন করেন স্যার স্টুয়াট কেভিন বেইলি। তিনি আরো জানান, বর্তমানে ময়লা-আর্বজনায় পরিপূর্ণ হয়েছে। আর ৪৮২ জন দখলদারের রাহুগ্রাসের কাছে নগরীর পয়ঃনিষ্কাশন প্রবাহের অন্যতম এই খালটি জিম্মি হয়ে পড়েছে। রংপুর নগরীর সিও বাজার এলাকার রমজান উদ্দিন জানান, ঘাঘট নদী থেকে শুরুহয়ে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ শ্যামা সুন্দরী খালটি নগরীর ভেতর দিয়ে খোখসা ঘাঘটের সাথে মিলেছে। বর্তমানে এটি সংস্কার না করার কারণে মশার নিরাপদ প্রজনন ও আবাস্থলে পরিণত হয়েছে। ৪০ থেকে ৯০ ফুট প্রস্ত খালটি এখন কোথাও কোথাও ৬ থেকে ৭ ফুটে পরিণত হয়েছে। অনেকে বাড়ির পয়ঃনিষ্কাশনের লাইন খালের সাথে সংযোগ করে দিয়েছেন। অন্যদিকে ইতিহাস বলছে রাজা জানকীবল্লভ সেন (১৮৩৫-১৯১০) ছিলেন রংপুরের জমিদার নীলকমল সেন ও চৌধুরাণী শ্যামা সুন্দরী দেবীর (দেবী চৌধুরাণী) পুত্র সন্তানা না থাকায় শ্যামা সুন্দরী দেবী তাকে বর্ধমান জেলার বাগনা গ্রাম থেকে দত্তক নেন। তিনি ডিমলার জমিদারিত্ব দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেন। তিনি জীবন বসু মহাশয়ের জ্যেষ্ঠা কন্যা শ্রীমতি রানী বৃন্দারানীকে বিয়ে করেন। তিনি রংপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন ১৮৯২-১৮৯৪ ইং পর্য। চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে ১৮৯২ সালে তার বাগান বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয় রংপুর পৌরসভা ভবন রাজা জানকী বল্লভ সেন, ছিলেন অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট, লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান ও জেলা বোর্ডের সদস্য।

সুত্র জানান, ১৮৯১ সালে ব্রিটিশ সরকার তার কাজে খুশি হয়ে তাকে রাজা উপাধি দেয়। তার মায়ের মৃত্যু ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়। রংপুর শহরে মশার উপদ্রব ঠেকাতে-১৮৯০ সালে ‘শ্যামা সুন্দরী খাল’ খনন করেন। তিনি বঙ্গের অনেক জমিদারকে নানাভাবে সাহায্য করেন। প্রজাদের অভাবে ৭৫ হাজার টাকার খাদ্য দান করেন। তৎকালীন রংপুরে কৃষি গবেষণার জন্য ৮ হাজার টাকা দান করেছিলেন। এ ছাড়া দার্জিলিঙের শিখরে হিন্দুদের জন্য হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন। আরো অনেক ইতিহাস এই শ্যামাসুন্দরী খাল নিয়ে।

রংপুর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মো. মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা জানান, খালটি খনন অর দখল মুক্ত করতে অভিযান করা আর ময়লা-আবর্জনায ফেলায় ভরে যাচ্ছে। খননের জন্য বরাদ্দ চেয়ে তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ঐত্যিবাহী শ্যামা সুন্দরী খালের স্বরূপ ফিরিয়ে এনে এটিকে দখল এবং দূষণমুক্ত করা বর্তমান সরকারের জন্য চ্যালেন্স হবে।