ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুসংবাদ প্রতিদিন : ঈশিতার আত্মনির্ভরশীলতার গল্প

হাঁস পালনে সচ্ছলতা ফিরেছে সংসারে

হাঁস পালনে সচ্ছলতা ফিরেছে সংসারে

ঈশিতা রানী বর্মন। পেশায় গৃহিণী। স্বামী পরিমল চন্দ্র বর্মন এক সময় দিনমজুরি করতেন। দুই সন্তানসহ চার সদস্যের সংসারে দুঃখ-কষ্ট ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। স্বামীর দিনমজুরির আয় দিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে ঈশিতা রানীর সংসারে। সংসারের অভাব এবং হতাশার হাতছানিকে উপেক্ষা করে স্বপ্ন দেখেন নিজে কিছু করার। স্বামীর উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে ২০০১ সালে হাঁস পালন করে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার স্বপ্ন দেখেন ঈশিতা। ঈশিতা রানীর বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার ধলাপাড়া ইউনিয়নের মুসল্লি পাড়া গ্রাম। বাড়ির চার পাশে বিলের উন্মুক্ত জলাশয়ে হাঁস পালন শুরু করেন ঈশিতা। এর জন্য আলাদা কোনো ঘরের প্রয়োজন হয়নি। বাড়তি কোনো খাবারেরও প্রয়োজন হয়নি। বিলের কিনারায় নেট জাল দিয়ে বেড়া দিয়ে সেখানে হাঁস রাখেন। পাশেই রয়েছে বাঁশের চাটাই এবং পলিথিনে ঘেরা আরেকটি টংঘর। সেখানে রাতে হাঁস পাহাড়া দেয় ঈশিতা এবং তার স্বামী পরিমল। একদিকে স্বামীর সংসারের ঘানি অন্য দিকে নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই নারী উদ্যোক্তা ঈশিতা। অভাবকে জয় করে সংসারে এনেছেন স্বচ্ছলতা। তার এই প্রচেষ্টা এবং ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প দেখে এলাকার অনেকেই তাকে অনুকরণ করে ঝুঁকছেন হাঁস পালনের দিকে।

সরজমিনে দেখা যায়, উপজেলার ধালাপাড়া সাগরদিঘী সড়কের ঘোড়াদহ সেতু থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গিয়েছে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। সামনেই মুসুল্লিপাড়া গ্রাম। গ্রামমটি নিচু এলাকা হওয়ায় প্রায় সারাবছর পানি থাকে। এখানে বাস করে ৯০ ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। এখানে বাস করেন ঈশিতা রানী। ঈশিতা রানী বলেন, আমি ২০০১ সাল থেকে কিছু কিছু করে হাঁস লালন-পালন করি। তারপর ধারদেনা করে ৫০টি হাসের বাচ্চা দিয়ে শুরু করি ছোট একটি খামার। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ধারদেনা সব পরিশোধ করেছি। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা এবং লাভের জমানো ১৫ হাজার টাকা দিয়ে চলতি বছর আমার খামারে ৩০ টাকা দরে ৫০০ হাঁসের বাচ্চা তুলেছিলাম। সবগুলোই দেশি হাঁস।

বর্তমানে আমার খামারে প্রায় ৪০০ হাঁস ডিম দিচ্ছে। কিছু হাঁস মারা গিয়েছে। বাকিগুলো পুরুষ হাঁস। হাঁসের ডিমের বাজার ভালো থাকায় প্রতিদিন ডিম বিক্রি করে আয় হচ্ছে প্রায চার হাজার টাকা। এতে আমার মাসে আয় হচ্ছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। সারাদিন হাঁসগুলো উন্মুক্ত জলাশয়ে খাবার খেয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খামারে চলে আসে। ডিম পাড়ার সময়ে দুপুরে বাড়তি খাবার হিসাবে ধানের কুড়া দিতে হয়। মাঝেমধ্যে হাঁসের ছোটখাটো রোগ-বালাই হলে ওষুধ দিতে হয়। এছাড়া আমার খামারে অন্য কোনো খরচ নেই। বাড়ির আশপাশের লোকজন ধান ভাঙায়, চাল থেকে যে কুড়া বের হয়, সেগুলো আমি পরিষ্কার করে দেই বিনিময়ে তারা আমাকে কুড়াগুলো দেয়।

বাইরের কোনো ওষুধ ও খাবার না খায়িয়ে নিজস্ব প্রাকৃতিক খাবার খায়িয়ে আমি হাঁস লালন-পালন করছি। এতে করে আমার খামারের হাঁস সুস্থ ও ভালো থাকে। চাহিদা ভালো থাকায় ডিম গুলো বাজারে নিতে হয় না। খামারে এসে পাইকার ডিম নিয়ে যায়। এতে দামও ভালো পাচ্ছি। আবার ডিম পাড়া শেষ হলে ও হাঁসের বয়স হলে প্রতিটি হাঁস ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা দরে বিক্রি করে দেই। হাঁস বিক্রি করেও প্রায দুই লাখ টাকার মতো আয় করতো পারব। তিনি আরো বলেন, আমাদের সংসারে আগে যেমন অভাব-অনটন ছিল বর্তমানে তা আর নেই। আমার দুই সন্তান রয়েছে। বড় মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। ছোট ছেলের বয়স ৪ বছর। মেয়ের পড়াশোনার খরচ ও সংসারের খরচ করে যে টাকা থাকে সেগুলো সঞ্চয় করি। পরিবার নিয়ে বর্তমানে সুন্দরভাবে চলতে পারছি।

আমার দেখাদেখি আমাদের এলাকার আরো লোকজন হাঁস পালনে আগ্রহী হয়ে উঠছে। বেকারদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, চাকরির পেছনে না ছুটে আমার মতো উদ্যোক্তা হলে আর বেকার কেউ থাকবে না। নিজেরাই কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে পারবেন। হাঁস পালন করা যেমন কষ্ট, তেমনি উপার্জিত অর্থ দিয়ে পরিবারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তার স্বামী পরিমল চন্দ্র বর্মন বলেন, আমি কাজের ফাঁকে স্ত্রীর এই হাঁসের খামার দেখা শুনাও করি। আমার অনেক ভালো লাগে, যখন খামারে সময় দেই। আগে আমি একা আয় করতাম, যে টাকা পেতাম কোনো রকমে সংসার চলত। আর বর্তমানে আমার স্ত্রী হাঁস পালন করে। আমাদের সংসার এখন ভালো চলছে।

আমার স্ত্রীর হাঁস পালন দেখে এলাকার নারী-পুরুষরা হাঁস পালনে আগ্রহ দেখাচ্ছে। ঘাটাইল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. বাহাউদ্দীন সারোয়ার রিজভী বলেন, ঈশিতা রানী উপজেলার একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। আমরা আশা করছি তার সফলতা দেখে এ উপজেলার অন্যান্য নারী-পুরুষ অনুপ্রাণিত হয়ে খামারি হয়ে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করবেন। তিনি আরো বলেন, আমাদের দপ্তর থেকে কোন প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই। তবে আমরা তাদের ফ্রিতে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। এছাড়াও সরকারি নির্ধারিত মূল্যে হাঁসের ভ্যাকসিন দিয়ে থাকি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত