ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

তেলবাহী জাহাজে বারবার আগুন

মেরামত করে চালানো হচ্ছে জাহাজ

মেরামত করে চালানো হচ্ছে জাহাজ

দেশে তেলবাহী জাহাজে আগুন লাগার ঘটনা বেড়েছে। দুই মাসে তিনটি তেলবাহী জাহাজে আগুন লেগেছে। এতে জাহাজে দায়িত্ব থাকা লোকজনের মৃত্যু ও আহতের ঘটনা ঘটেছে। একইসঙ্গে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে তেলবাহী জাহাজের দুর্বলব্যবস্থাপনা বিশ্ব দরবারে ফুটে উঠবে। যা জাতীয় পর্যায়ে জ্বালানি নিরাপত্তার ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে তুলবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ৩০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বাংলার জ্যোতি নামে একটি তেলবাহী জাহাজে বিস্ফোরণের ফলে আগুন ধরে। বিস্ফোরণের সময় ট্যাংকারে ১১ হাজার ৭০০ টন ক্রুড অয়েল ছিল। বিস্ফোরণে জাহাজের ডেক ক্যাডেট সৌরভসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। এর চারদিন পরে ৫ অক্টোবর বাংলার সৌরভ তেলবাহী জাহাজে আগুন লাগে। বাংলার সৌরভে ১১ হাজার ৫৫ টন অপরিশোধিত তেল ছিল।

সর্বশেষ গত ২৭ অক্টোবর চাঁদপুরে ডাকাতিয়া নদীতে ‘এমভি সাদিয়া এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি তেলবাহী জাহাজে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর পদ্মা ডিপোতে আসে জাহাজটি। পুরো ট্যাংকারে পেট্রল ও ডিজেল ছিল। হঠাৎ ইঞ্জিনকক্ষে জেনারেটর বিস্ফোরণ হয়। এতে আগুন ছড়িয়ে পড়লে জাহাজে থাকা সবাই নদীতে ঝাঁপ দেন। জাহাজে থাকা ছয়জন অগ্নিদগ্ধ হন। জানা গেছে, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) মালিকানাধীন সচল সাতটি জাহাজের মধ্যে বাংলার সৌরভ ও বাংলার জ্যোতি বন্দরের বহির্নোঙ্গর থেকে তেল লাইটারের কাজ করত। অপর পাঁচটি জাহাজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত আছে।

১৯৮৭ সালে নির্মিত জাহাজ দুটি ডেনমার্ক থেকে কেনার পর বিএসসির বহরে যুক্ত হয়। জাহাজ নির্মাণের সাথে যুক্তরা জানান, এ ধরনের জাহাজের লাইফটাইম ২০ থেকে ২৫ বছর হলেও ৩৬ বছরের বেশি সময় ধরে জাহাজ দুটি দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) ১২ থেকে ১৪ লাখ টন অপরিশোধিত তেল পরিবহন করে বিএসসি। বড় জাহাজে বিদেশ থেকে এসব তেল আমদানি করে বহির্নোঙরে আনা হয়। এরপর সাগরে বিএসসির বাংলার জ্যোতি ও বাংলার সৌরভে লাইরারিং করে কর্ণফুলী নদীর ডলফিন জেটিতে ইস্টার্ন রিফাইনারিকে দেয়া হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি জাহাজ ২৫ বছর পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকে। এরপর জাহাজ স্ক্র্যাপ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বিএসসি জাহাজ দুটিকে স্ক্র্যাপ ঘোষণা না করে মেরামত করে ৩৬ বছর ধরে জ্বালানি পরিবহন করছে। জাহাজ দুটি পুরোনো হওয়ার কারণে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে। তেলবাহী জাহাজে বিস্ফোরণ রোধে কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা ও কচ্ছপ গতি সব মহলকেই বিস্মিত করেছে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ ধরনের তেলবাহী জাহাজ বিস্ফোরণের দুর্ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মোকাবিলা করেছে। এরই মধ্যেই এ কাজের টেকনোলজি বহুদূর এগিয়েছে। তেলবাহী জাহাজে আগুনের দুর্ঘটনা ঘটলে কারিগরি ও আধুনিক যন্ত্রনির্ভর ব্যবস্থা নেয়া হয়। বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের তেলবাহী জাহাজ ‘বাংলার জ্যোতি’তে বিস্ফোরণের পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বিস্ফোরণের একদিন পর বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা তেলবাহী জাহাজে অতিরিক্ত দাহ্য গ্যাস জমা হওয়ায় আগুন ধরে বিস্ফোরণ ঘটে। ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শরিফ হাসনাতের নেতৃত্বে গঠিত বিপিসির তদন্ত কমিটিকে বেধে দেওয়া ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দেয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, জেটিতে নোঙর করার পর জাহাজটি থেকে ক্রুড অয়েল খালাসের কাজ শুরু হয়। প্রায় ৮০০ মেট্রিক টন ক্রুড অয়েল খালাসের পর জাহাজটির ফোর পিক সেকশনে, যেখানে রশি, নোঙর, স্পেয়ার পার্টস রাখা হয় সেখানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেখানে ডেক ক্যাডেট সৌরভ কুমার সাহা, বিএসসির ফোরম্যান নুরুল ইসলাম ও শ্রমিক মো. হারুন কাজ করছিলেন সে সময়। তারা তিনজনই বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মো. শরিফ হাসনাত বলেন, আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। যেহেতু সময় কম ছিল, তাই প্রতিবেদন সংক্ষিপ্ত হয়েছে। এতে কিছু সুপারিশ ও পর্যবেক্ষণের কথা জানানো হয়েছে। বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান বলেন, প্রতিবেদন পেয়েছি। জ্বালানি তেলের কোনো ক্ষতি হয়নি।

বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেক বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত বাংলার জ্যোতি জাহাজের সব বৈদ্যুতিক তার বিচ্ছিন্ন করে, ঝুঁকি কমিয়ে তারপর জ্বালানি তেল খালাসের ব্যবস্থা করা হয়।

বিপিসির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে কিছু বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। এরমধ্যে- দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও বিদ্যমান লাইটার জাহাজ দুটির ব্যবহারের উপযুক্ততা নির্ধারণের লক্ষ্যে একটি কারিগরি কমিটি গঠনের জন্য বিএসসিকে অনুরোধ করা যেতে পারে। বিএসসির লাইটার জাহাজ ‘বাংলার জ্যোতি’ এবং ‘বাংলার সৌরভ’ ব্যবহার করে ক্রুড অয়েল লাইটারিং কার্যক্রম পরিচালনা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আমদানি করা ক্রুড অয়েল খালাসের জন্য সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন অবিলম্বে চালু করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণে ঠিকাদার নিয়োগ দ্রুত করা গেলে নিরাপদে ক্রুড অয়েল খালাস করা সম্ভব হবে। জেটিতে থাকা অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা আরো আধুনিক করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।

এদিকে বাংলার সৌরভ তেলবাহী জাহাজে আগুন লাগার ঘটনার পর বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেক বলেছিলেন, রাত সাড়ে ১২টায় জাহাজে কোনো কাজ ছিল না। জাহাজে চারটা পয়েন্টে আগুন দেখা যায়। তাই আমাদের আশঙ্কা নাশকতা। পর পর দুইটি অয়েল ট্যাংকারে আগুন জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার অপচেষ্টা বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।

বিএসসির সম্মেলনকক্ষে সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদুল মালেক বলেন, কয়েক দিন আগে বাংলার জ্যোতিতে আগুন লেগেছিল। এবার আগুন লাগল বাংলার সৌরভে। তাই আমরা ধারণা করছি, এ ঘটনা জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলার অপচেষ্টা। এই ঘটনায় কারা জড়িত, তা শনাক্ত করা উচিত।

মাহমুদুল মালেক আরো বলেন, এটি লাস্ট সার্ভিস হওয়ার কথা ছিল বাংলার সৌরভের। নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড ও বন্দরের সাতটি টাগ একযোগে কাজ করে। আগুন নেভানোর দেড় ঘণ্টা পর আবার আগুন ধরে যায়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে নাশকতার বিষয় নিশ্চিত হলে আইনিব্যবস্থা নেয়া হবে।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, এত বেশি পুরোনো জাহাজ বিশ্বের অন্যান্য দেশে চলার সুযোগ কম। কারণ জাহাজ বেশি পুরাতন হলে ওই জাহাজে নানা ধরনের ত্রুটি ধরা পড়ে। যে কারণে দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। প্রত্যেকটি জাহাজকে একটি ক্লাসের অধীনে চলতে হয়। ওই ক্লাস জাহাজটির সেফটি সিকিউরিটিগুলো এনসিউর করে। কিন্তু আমাদের দেশে বিশেষ করে কোস্টাল ভ্যাসেল চলাচলে এর কোনো বালাই নেই। সেফটি সিকিউরিটি সার্টিফিকেট ছাড়াই অনেক জাহাজ চলাচল করছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত