গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের প্রস্তুতি পুরোদমে শুরু হয়েছে। বিচারকাজ পরিচালনার জন্য ট্রাইব্যুনালের অবকাঠামোগত কিছু সংস্কার করা হচ্ছে, যা শেষের পথে। এই কাজ শেষ হলে নতুন আঙ্গিকে শুরু হবে বিচারকাজ। এতে বিচারিক প্রক্রিয়ায় গতি আসবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। চলতি নভেম্বরেই পরিবর্তন হচ্ছে ট্রাইব্যুনালের বিচারের জন্য নির্ধারিত স্থান। টিন শেড থেকে আসামিদের বিচারের স্থান পরিবর্তন করে নেয়া হচ্ছে হাইকোর্টের পুরনো ভবনে। সেখানেই ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম বিচারকাজ শুরু হয়েছিল। সরেজমিন দেখা যায়, ট্রাইব্যুনালের ঐতিহাসিক সেই সাদা ভবনটির নানামুখী সংস্কার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন মিস্ত্রি ও কর্মীরা। কেউ কেউ চুনকাম করছেন। কেউ করছেন ঘষামাজার কাজ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। চুন মিস্ত্রি আবুল হাসেম বলেন, ‘আমাদের কাজ প্রায় শেষের দিকে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা পরিশ্রম করেই যাচ্ছি।’ আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই সংস্থার কাজ শেষ হবে বলে জানান তিনি। সংস্থার কাজ শেষ হতে আরও সপ্তাহখানেক লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ। তিনি বলেন, কাজ চলমান আছে, সময় লাগবে। শ্রমিকরা নিয়মিতভাবে কাজ করছেন। সংস্কার কাজের সিংহভাগ সম্পন্ন হয়েছে। টুকিটাকি কিছু কাজ বাদ আছে। একাজগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করছি। এছাড়া ট্রাইব্যুনাল সংলগ্ন বাগান পরিষ্কার করে নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে এই সংস্কার কাজের সার্বিক তদারকি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সংস্কার কাজ পরিদর্শন করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। এর আগে সংস্থার কাজ পরিদর্শন করেন গণপূর্তের চিফ ইঞ্জিনিয়ারসহ সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ের অনেকেই।
সবশেষ গত বৃহস্পতিবার সংস্কার কাজ পরিদর্শন করেন গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। এসময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, খুব শিগগির সংস্কার কাজ শেষে বিচারের স্থান পরিবর্তন করা হচ্ছে। এদিকে হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারকে চেয়ারম্যান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। যেখানে ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য আছেন হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে গত ১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
গত ৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এছাড়া প্রসিকিউশন টিমের অপর পাঁচ প্রসিকিউটর হলেন মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম, বিএম সুলতান মাহমুদ, আবদুল্লাহ আল নোমান ও মো. সাইমুম রেজা তালুকদার। এছাড়া ১০ জন কর্মকর্তার সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থাও পুনর্গঠন করা হয়েছে। গত জুলাই মাস থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন অফিসে অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। এরইমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ শুরু হয়েছে। গণহত্যার অভিযোগে পুলিশের মিরপুরের সাবেক ডিসি জসিম উদ্দিন, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা শহিদুল ইসলামকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
জুলাই-আগস্ট গণহত্যার অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা মামলায় আসামিদের মধ্যে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, দীপু মনিসহ ১৪ জনকে হাজির করতে নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। আগামী ১৮ নভেম্বর তাদের হাজির করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের ট্রাইব্যুনালে করা মামলায় গ্রেফতার দেখাতে বলা হয়েছে। অন্য মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা যাদের ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তারা হলেন- সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ড. আব্দুর রাজ্জাক, গোলাম দস্তগীর গাজী, শাহজাহান খান, দীপু মনি, ফারুক খান, কামাল আহমেদ মজুমদার, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তৌফিক এলাহী, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলম।
আলাদা আবেদনে সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানসহ ছয়জনকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ট্র্যাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তারা হলেন- পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল কাফি, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, পুলিশ কর্মকর্তা আরাফাতুল ইসলাম, তেজগাঁও থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি মাজহারুল ইসলাম, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল হাসান।