ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পলিথিন উৎপাদন বন্ধে অভিযান শুরু

নিষিদ্ধের পরেও কাঁচাবাজারে মিলছে পলিথিন ব্যাগ

নিষিদ্ধের পরেও কাঁচাবাজারে মিলছে পলিথিন ব্যাগ

দেশজুড়ে নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের পরিবেশ। পরিবেশের বিরূপ প্রভাব বিস্তারকারী পলিথিন মাটির স্বাভাবিক স্তর ধ্বংস করছে। পলিথিন বর্জ্যরে ক্ষতিকর দিকগুলো আলোচিত হলেও পলিথিন বন্ধে বাস্তবে সুফল দেখা যায়নি। আইন থাকলেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইন বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সারা দেশে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার বন্ধে আইনি কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এরইমধ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগের কারণে সুপারশপগুলোয় পলিথিন ব্যাগের বিকল্প ব্যাগ ব্যবহার করছেন বিক্রেতা-ক্রেতারা। তবে গত শুক্রবার কাঁচাবাজারেও পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু কারওয়ানবাজার, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, মোহাম্মাদপুর, শ্যামলীসহ রাজধানীর প্রত্যেকটি কাঁচাবাজারে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করতে দেখা গেছে বিক্রেতা ও ক্রেতাদের।

গত দেড় মাস আগে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধের ঘোষণা দিয়েও বাজার থেকে ওঠেনি ক্ষতিকর এই পণ্য। বাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ী জানান, পলিথিনের বিকল্প অন্য কোনো ব্যাগ আমরা পাচ্ছি না, কীভাবে দেব। যার ফলে নিরুপায় হয়ে পলিথিনে করেই মাল দিচ্ছি। কাস্টমাররা যদি ব্যাগ নিয়ে আসেন আমরা ব্যাগেই দেবো। কিন্তু কোনো কাস্টমারকে পাটের ব্যাগ আনতে দেখিনি। মালিবাগ রেলগেট সংগলগ্ন বাজারের সবজি বিক্রেতা আলমগির হোসেন বলেন, পলিথিন নিষিদ্ধ হয়েছে এটা জানি না। শুনলাম এক মাস সময় বাড়াইছে। আমাদের দৈনিক ২০০ টাকার পলিথিন লাগে। এর বিপরীত কোথাও থেকে যে পাটের ব্যাগ কিনব সেই ব্যবস্থা তো নেই। ব্যাগ পেলে দোকানে দোকানে ব্যাগ ঝুলিয়ে রাখতাম। বাজারের বেশ কয়েকজন ক্রেতা জানান, সবজি, মুদি আইটেম তারা পাটের ব্যাগে করেই নিতে চান। তবে বাজারে পলিথিন ব্যাগের বিকল্প ব্যাগ না পাওয়ায় অভিযোগ করেছেন ক্রেতারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, আজ থেকে বাজার ও পলিথিন ব্যাগের উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে আইনি পদক্ষেপ নেবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। দেশে পলিথিন ব্যাগের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চরম ব্যর্থতার চিত্র উঠে এসেছে। ঢাকা শহরের প্রতিটি অলিগলি, ড্রেন, নালা, খাল ও পতিত জলাশয়ে পলিথিনের স্তূপ। পরিবেশ অধিদপ্তর ২০০২ সালে শর্ত সাপেক্ষে সব রকমের পলিথিন শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি, মজুত ও বিতরণ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু বাস্তবে পলিথিনের ব্যবহার কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। কাগজে-কলমে আইন থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। ফলে উৎপাদক, আমদানিকারক, বিক্রেতা-ক্রেতা পলিথিনের শপিং ব্যাগ-সংক্রান্ত আইন মানছেন না।

বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হয়। পলিথিন ছাড়া অন্য প্লাস্টিক বর্জ্যও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। নিষিদ্ধ পলিথিন বন্ধে উৎপাদন থেকে শুরু করে ব্যবহারকারী পর্যন্ত কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। পলিথিন কারখানা সিলগালা করতে হবে। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে কাগজ বা পাটের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘোষণা অনুযায়ী নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার বন্ধে গতকাল পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তর গঠিত মনিটরিং কমিটি বাজার ঘুরেছেন। কমিটির সদস্যরা রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও আশপাশের বিভিন্ন সুপারশপে বাজার মনিটরিং করেন।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গত ২৭ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ১ নভেম্বর থেকে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার বন্ধে কঠোর মনিটরিং করা হবে। এরই ধারাবাহিকতা গত শুক্রবার মনিটরিং শুরু করেন কমিটির সদস্যরা। মনিটরিং কমিটির সদস্যরা বাজার করতে আসা মানুষকে পলিথিন ব্যবহার না করে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারের অনুরোধ জানান। একই সঙ্গে দোকানিদের পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার বন্ধে নির্দেশনা দেয়া হয়। পরবর্তী অভিযানে পলিথিনের ব্যাগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানানো হয়।

পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, সতর্ক করা এবং কঠোর হওয়ার সময় পার হয়ে গেছে। অভিযানে কঠিন শাস্তি ও জরিমানার বিধান রয়েছে। তবে শাস্তি দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। ক্ষতিকর এই ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগ বন্ধের পর যেন বিকল্প ব্যাগের চাহিদা অনুযায়ী যোগান দেওয়া যায়, সেজন্য বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনসহ ২০-২৫টি প্রতিষ্ঠান পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগ সরবরাহ করবে।

পরিবেশ মন্ত্রণালয় গঠিত মনিটরিং টিমের আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ) তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, পরিবেশ রক্ষায় আজ থেকে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে। জেলা প্রশাসক এবং পরিবেশ অধিদফতরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।

বড় পরিসরে পলিথিন বন্ধের আগে সরকারের প্রস্তুতি, বিকল্প ব্যাগের চাহিদা ও যোগান নিয়ে তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, বিকল্প আর কী কী হতে পারে তা নিয়ে কাজ চলছে। সামনের দিনে আরও বিকল্প আসবে। তখন চাহিদা অনুযায়ী যোগান আরো বাড়বে। তবে এক দিনে তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন আসবে। কোনো পরিবর্তন হয়নি এমন তো নয়, বরং গত এক মাসে আমরা ইতিবাচক অনেক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি।

২০২৩ সালে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় শহরে প্রতিদিন আড়াই কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হয়। ঢাকায় এক একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে পাঁচটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। দেশে প্রতিদিন ৩৫ লাখের বেশি টিস্যু ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাত হয়। এসব ব্যাগ কৃত্রিম তন্তু দিয়ে তৈরি হলেও কাপড়ের ব্যাগ বলে চালিয়ে দেয়া হয়।

চেইন শপ স্বপ্নর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সাব্বির হাসান নাসির বলেন, প্রতিদিন আমাদের প্রায় এক লাখ ব্যাগের প্রয়োজন হয়, সেই হিসেবে মাসে ত্রিশ লাখ। সেই চাহিদার এক থেকে দুই শতাংশ এখন পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। চাহিদা পূরণ করার জন্য ছোট বড় বিভিন্ন সাপ্লায়ার ও পাটকলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

তিনি করেন, দেশের পাটকল সাধারণত চট তৈরি করে, কিন্তু চট থেকে ব্যাগ তৈরির ইন্ডাস্ট্রি সেভাবে ডেভলপ করেনি। এগুলো ডেভলপ হলে আমরা আমাদের চাহিদা পূরণ করতে পারব। আমার ধারণা, আগামী জানুয়ারি নাগাদ আমাদের চাহিদা অনুযায়ী পাটের ব্যাগের যোগান পাওয়া সম্ভব হবে।

পলিথিন ব্যাগ বন্ধে পাটের ও চটের ব্যাগের চাহিদা বাড়ায় উদ্যোক্তারা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন কয়েকটি সুপারশপের কর্মীরা। বিষয়টি নিয়ে ২১ অক্টোবর পরিবেশ অধিদপ্তরের সভাকক্ষে ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সঙ্গে মতবিনিময় সভাতেও আলোচনা হয়। পরিবেশ উপদেষ্টা সেই সভায় বলেন, সুপারশপে পলিথিন ব্যাগ বন্ধের পর ক্রেতারাই তা নিতে চাচ্ছেন না। কিন্তু দোকানিরা একটি করে পাটের ব্যাগ বেশি দাম দিয়ে বিক্রি করছে, দোকানিরা বলার চেষ্টা করছে পাটজাত পণ্যের উদ্যোক্তারা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এটাই তো আমার দেশ। আমরা তো ভিন্ন কোনো দেশে বসবাস করি না। যাই হোক, পলিথিনের বিকল্প আমরা পাট ও চট এটা দিয়েই করব। এতে আমাদের দেশীয় শিল্প উঠে আসবে।

দামের বিষয়টি নিয়ে অন্যভাবে ভাবার কথা বললেন জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য কোম্পানি ডিজাইন বাই রুবিনার ব্র্যান্ড ম্যানেজার নাজমুল হাসান। তিনি বলেন, অনেকেই মনে করেন পাট খুব সস্তা জিনিস, ৫ টাকা ১০ টাকায় পাওয়া যাবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আসা ক্রেতাদের এমন ভুল ধারণা থেকে বের হতে হবে। কম দামে পলিথিন কিনে তা একবারের বেশি ব্যবহার করা যায় না। অন্যদিকে ৫০ টাকার একটি পাটের ব্যাগ ২-৩ মাস ধুয়ে ব্যবহার করা যায়। এভাবে হিসাব করলে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের লাভ বোঝা যাবে। বাজারে যে পরিমাণ পাট আছে, তাতে চাহিদা পূরণ সম্ভব বলে মনে করেন এই উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, চাহিদা বাড়লে পাটের ব্যাগের দাম আরো কমবে। এছাড়া বেশি ব্যবহার হলে বিভিন্ন রকম ব্যাগের উদ্ভাবনও হবে।

প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালে বিএনপির পরিবেশমন্ত্রী শাজাহান সিরাজ বাজারগুলোকে পলিথিনমুক্ত করেছিলেন। গত প্রায় ১৮ বছরের সেই পলিথিনের ব্যবহার বাজারে বেড়ে যায়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শিথিল নীতির কারণে পলিথিনে সয়লাব হয়ে ওঠে বাজারে। এবার পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন পরিবেশ উপদেষ্টা। এ জন্য পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে টানা বেশ কয়েকটি সভাও করেন তিনি। পলিথিনের বিকল্প পণ্য নিয়ে একটি মেলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এতে মূলত পাটজাত পণ্যের নানা ধরনের ব্যাগের প্রদর্শনী করা হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত