মিষ্টি খেতে পছন্দ করেন না এমন মানুষ পাওয়া খুবই কঠিন। ছোট বড় সব বয়সের মানুষের পছন্দের খাবারের তালিকায় মিষ্টি থাকবেই। এ ছাড়া বিয়ে-শাদি, জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, মিলাদ মাহফিল, ঈদ, পূজো সহ যে কোনো সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মিষ্টি না থাকলেই নয়। তাই মানুষের চাহিদা পূরণ করতে নানা ধরনের মিষ্টি তৈরি করে থাকেন ব্যবসায়ীরা। তেমনই এক বৈচিত্রময় মিষ্টি ‘পুতা মিষ্টি’। একটা মিষ্টির ওজন দেড় থেকে আড়াই কেজি। দেখতে অবিকল পুতার মতো। তাই ‘পুতা মিষ্টি’ নামেই এই মিষ্টি প্রসিদ্ধ লাভ করেছে। তাই হাটের মূল আকর্ষণই হচ্ছে পুতা মিষ্টি। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায় মোঘল আমলের প্রায় ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী কাইক্কারটেক হাটে পাওয়া যায় এই পুতা মিষ্টি। প্রতি সপ্তাহের রোববার ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে এই হাট। এই হাট পুতা মিষ্টি ছাড়াও কাঠের তৈরি নৌকা ও গরু-ছাগল বেচাকেনার জন্য প্রসিদ্ধ। তবে এই হাটে এখন আর আগের মতো গরু-ছাগল বেচাকেনা হয় না। পুতা মিষ্টি ও নৌকার পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে হাটটি। বর্তমানে এই হাটে মাত্র দুইটি দোকানে বিক্রি হয় এই পুতা মিষ্টি। যেমন স্বাদ, তেমন তৃপ্তি। কোনোটাই কম নয়। তাই দোকানে ক্রেতাদের ভীড় লেগেই থাকে। মুখরোচক এই পুতা মিষ্টির স্বাদ গ্রহণ করতে রাজধানি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পরিবার ও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে মানুষ ভীড় করেন কাইক্কারটেক হাটে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের আর কোথাও এই মিষ্টি পাওয়া যায় না বলে জেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষও পুতা মিষ্টি খেতে এই হাটে আসেন। বাড়িতেও কিনে নিয়ে যান অনেকে। এক কেজি পুতা মিষ্টি বিক্রি হয় দুইশ থেকে আড়াইশ’ টাকায়।
মিষ্টির কারিগররা জানান, মিষ্টির কারখানায় ১০টা পুতা মিষ্টি এক সাথে বানানো যায়। সময় লাগে দেড় ঘন্টা। গরুর দুধের ছানা, বিভিন্ন প্রকার মশলা, মাওয়া ও গুটলি সহ বিভিন্ন প্রকার উপকরণ দিয়ে তৈরি হয় বলে পুতা মিষ্টির এতো স্বাদ ও মুখরোচক। তাই পুতা মিষ্টির নাম সবার মুখে মুখে। হাট ঘুরে জানা গেছে, সোনারগাঁ উপজেলার আনন্দবাজার এলাকার মিষ্টি ব্যবসায়ী চন্দন ঘোষ তাদের বংশের চার পুরুষের এই ব্যবসাটি ধরে রেখেছেন। দাদার বারা থেকে শুরু করে বংশ পরম্পরায় চার পুরুষ ধরে পুতা মিষ্টির ব্যবসা ধরে রেখেছেন তিনি। চন্দন ঘোষ বলেন, পুতা মিষ্টির ব্যবসা আমার দাদার বাবা করেছে। দাদা করেছে। বাবা করেছে। আমি নিজে করছি ১৬ বছর ধরে। আমার দোকানের বিভিন্ন প্রকার মিষ্টির মধ্যে পুতা মিষ্টিই সেরা। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী একটা পুতা মিষ্টি সচরাচর দেড় কেজি থেকে আড়াই কেজি ওজনের বানানো হয়ে থাকে। তবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্ডার পেলে একটা পুতা মিষ্টি ৮ কেজি ওজনেরও তৈরি করি।
চন্দন ঘোষ আরো বলেন, আমার দোকানের পুতা মিষ্টি কিনে দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশেও নিয়ে যাচ্ছেন ক্রেতারা। ইতালি, জাপান, অষ্ট্রেলিয়া, জার্মানী, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের প্রবাসীরা আমার দোকানের পুতা মিষ্টি কিনে ওইসব দেশে নিয়ে গেছেন।
চন্দন ঘোষ জানান, ক্রেতা সমাগম ও আবহাওয়া ভালো থাকলে সপ্তাহের একদিনের হাটে দোকানে লাখ টাকার বেশিও পুতা মিষ্টি বিক্রি হয়ে থাকে। তবে চিনিসহ বিভিন্ন উপকরণের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি বেশি হলেও লাভের মুখ দেখছেন না তিনি। শুধুমাত্র ক্রেতাদের চাহিদা ধরে রাখতে লোকসান দিয়েই বিক্রি করতে হচ্ছে পুতা মিষ্টি। সরকার চিনির মূল্য নিয়ন্ত্রণ না করলে কয়েকশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহি এই পুতা মিষ্টি অচিরেই হারিয়ে যাবে এমন আশংকর কথাও জানান মিষ্টি ব্যবসায়ী চন্দন ঘোষ। হাটে আসা লক্ষনখোলা এলাকার বাসিন্দা মামুন খান বলেন, কাইক্কারটেক হাট পুতা মিষ্টির জন্য বিখ্যাত। এই মিষ্টি আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। বহু জায়গায় মিষ্টি খাই, তবে পুতা মিষ্টির স্বাদ অন্য রকম লাগে। সিদ্ধিরগঞ্জের মোবাইল ব্যবসায়ী রনি বলেন, বাপ-দাদার কাছ থেকে এই হাটের পুতা মিষ্টির অনেক গল্প শুনে আসছি। নিজেই তো ২০ বছরের বেশি সময় ধরে পুতা মিষ্টি খাই।
স্থানীয়রা জানান, পুতা মিষ্টি ছাড়াও এই হাঁটে এখনো তুলনামূলক স্বল্প মূল্যে সব পণ্য পাওয়া যায়। থাকে প্রয়োজনীয় সব পণ্যের মজুদও। তাই এখনো বেশ জনপ্রিয় হাঁটটি। কাইকারটেক হাট কমিটির সভাপতি বাদশা মিয়া বলেন, এই বাজার থেকে সরকার বছরে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা রাজস্ব পায়। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী এই হাঁটের ঐতিহ্য ধরে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। আমরা চাই সরকার এই হাট সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণ করুক। বহুকাল ধরে গ্রামবাংলার অর্থের চাকা সচল রাখা এই হাঁটের ঐতিহ্য যুগ যুগ ধরে টিকে টিকে থাকবে এমন প্রত্যাশার কথাও জানান তিনি।