ভারতে ১০০ দিন : কী অবস্থায় আছেন হাসিনা?

প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আন্তর্জাতিক ডেস্ক

গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যখন ভারতে পা রাখেন, দিল্লির বিশ্বাস ছিল, তার এ যাওয়া একেবারেই সাময়িক। যে কোনো মুহূর্তে তৃতীয় কোনো দেশের উদ্দেশে তিনি রওনা হয়ে যাবেন, এ ধারণা থেকেই প্রথম দু-চার দিন তাকে (ও সঙ্গে বোন শেখ রেহানাকে) রাখা হয়েছিল দিল্লির উপকণ্ঠে গাজিয়াবাদের হিন্দন বিমানঘাঁটির টার্মিনাল বিল্ডিংয়ে। যেটির নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ভার দেশের বিমান বাহিনীর। সহসা শেখ হাসিনার তৃতীয় কোনো দেশে পাড়ি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠার পর ভারত সরকার তাকে হিন্দন থেকে সরিয়ে নেয় দিল্লির কোনো গোপন ঠিকানায়। পরে তাকে হয়তো দিল্লির কাছাকাছি অন্য কোনো সুরক্ষিত আশ্রয়ে সরিয়েও নেয়া হয়েছে- তবে এ বিষয়ে ভারত সরকার এখনো কোনো তথ্যই প্রকাশ করেনি। কিন্তু ‘ঠিকানা’ যা-ই হোক, ভারতে তার পদার্পণের ১০০ দিনের মাথায় এসে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, এখন শেখ হাসিনাকে কীভাবে ও কী ধরনের নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে? আর এর পেছনে কারণই বা কী? পাশাপাশি এ চরম অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তিনি স্বাধীনভাবে কতটা কী করতে পারছেন? কিংবা ‘আশ্রয়দাতা দেশ’ হিসেবে ভারত কি তাকে কোনো কোনো কাজ না-করারও অনুরোধ জানিয়েছে? দিল্লিতে একাধিক মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা ও ওয়াকিবহাল মহলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বিবিসি বাংলা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে।

কেমন নিরাপত্তা পাচ্ছেন হাসিনা? : সরকারি পদমর্যাদা ও নিরাপত্তাগত ঝুঁকি বিবেচনায় ভারতের ভিভিআইপিরা বিভিন্ন ক্যাটেগরির নিরাপত্তা পেয়ে থাকেন যার মধ্যে ‘জেড প্লাস প্লাস’কেই সর্বোচ্চ বলে ধরা হয়। প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা অবশ্য সম্পূর্ণ আলাদা মানদ-ে আয়োজন করা হয়, ‘স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপ’ বা এসপিজি কমান্ডোরা সচরাচর বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় রেখে তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সামলান। যে ভিভিআইপিদের নিয়মিত প্রকাশ্যে আসতে হয়, আর যাদের লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকলেও চলে- অবশ্যই তাদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার আয়োজনও হয় কিছুটা ভিন্ন ধাঁচের। শেখ হাসিনার জন্য ভারত এখন ঠিক কোন ধরনের নিরাপত্তা প্রোটোকল অনুসরণ করছে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তাকে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কিছুটা ইঙ্গিত দেন। এ কর্মকর্তা গত ১০০ দিন ধরে ভারতে শেখ হাসিনার প্রতিটি পদক্ষেপের বিষয়ে সম্পূর্ণ অবগত।

ক্ষুদে বার্তায় তিনি ছোট তিনটি বাক্যে এ প্রশ্নের যে উত্তর দিলেন, ‘বেয়ার মিনিমাম, প্লেন ক্লদস, নো প্যারাফারনেলিয়া!’ এর অর্থ হল, যেটুকু না-হলে নয় শেখ হাসিনাকে সেটুকু নিরাপত্তাই দেয়া হয়েছে, সাদা পোশাকের রক্ষীরাই তার চারপাশে ঘিরে রয়েছেন (কমান্ডো বা সেনা সদস্যরা নন)। ঢাকঢোল পিটিয়ে বা ঘটা করে তাকে কোনো নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে না, বরং পুরো জিনিসটাকে খুব নিচু তারে বেঁধে রাখা হয়েছে। ‘ইন হার কেস, সিক্রেসি ইজ দ্য সিকিউরিটি!’ সোজা কথায়, তার বেলায় গোপনীয়তাই হলো নিরাপত্তা! এটারও অর্থ খুব সহজ- শেখ হাসিনার অবস্থানের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে গোপনীয়তা রক্ষার ওপর, কারণ তিনি কোথায়, কীভাবে আছেন তা যত গোপন রাখা সম্ভব হবে, ততই তার নিরাপত্তা নিশ্চিদ্র করা সহজ হবে। ‘মুভমেন্টস অ্যান্ড ভিজিটস- অ্যাজ লিটল অ্যাজ পসিবল!’ শেখ হাসিনাকে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া, কিংবা তার সঙ্গে অন্যদের দেখা করানোর ব্যবস্থা- যতটা সম্ভব এড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে শেখ হাসিনার মুভমেন্টস বা ভিজিটস যে পুরোপুরি বন্ধ নয়, এ কথায় সে ইঙ্গিতও রয়েছে! ওই কর্মকর্তার কথা থেকে স্পষ্ট, শেখ হাসিনার জন্য কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকলেও সেটা খুব বিশেষ এক ধরনের আয়োজন- মানে ধরা যেতে পারে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য যে ধরনের নিরাপত্তা থাকে, তার সঙ্গে সেটা মাত্রায় তুলনীয় হলেও আয়োজনে একেবারেই অন্য রকম! শেখ হাসিনাকে যাতে কোনোভাবেই প্রকাশ্যে না-আসতে হয়, এ প্রোটোকলে সেই চেষ্টাও বিশেষভাবে দেখা যায়। দিল্লির লোদি গার্ডেনে তিনি এসে মাঝেমাঝে হাঁটাহাঁটি করে যাচ্ছেন, কিংবা ইচ্ছা করলেই নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায় কাওয়ালি শুনে আসছেন- এ ধরনের যাবতীয় জল্পনা হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছেন ভারতের সংশ্লিষ্ট মহলের কর্মকর্তারা!

ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে সাক্ষাৎ : গত ৫ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা দিল্লিতে এসে নামলেন, সে দিনই সন্ধ্যায় দিল্লিতে কংগ্রেসের একদা মুখপাত্র শর্মিষ্ঠা মুখার্জি নিজের এক্স হ্যান্ডল থেকে একটি টুইট করেন। তাতে তিনি লেখেন, ‘স্টে সেফ অ্যান্ড স্ট্রং, হাসিনা আন্টি। টুমরো ইজ অ্যানাদার ডে, মাই প্রেয়ার্স আর উইথ ইউ!’ শর্মিষ্ঠা মুখার্জির আর একটা পরিচয় হলো, তিনি ভারতের প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কন্যা। খুব ছোটবেলায় শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে তার যে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল, তা আজও এতটুকু ম্লান হয়নি বলেই তিনি ওই কথাগুলো সেদিন বলতে পেরেছিলেন।

হাসিনার প্রথম দফায় ভারতে অবস্থানকালে দিল্লিতে বহুদিন ছিলেন। এর সুবাদে তার নিজস্ব পরিচিতিরও একটি বলয় গড়ে ওঠে, যাদের মধ্যে কেউ কেউ এখনও জীবিত বা সক্রিয় আছেন। কিংবা দিল্লিতে আজও আছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক কর্নেল অশোক তারার মতো কেউ, যিনি একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর সকালে ধানমন্ডিতে পাকিস্তানি সেনাদের পাহারায় থাকা শেখ হাসিনাসহ মুজিব পরিবারের সদস্যদের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। আজও অশোক তারা ও তার স্ত্রী, দুজনের সঙ্গেই শেখ হাসিনার দারুণ সুসম্পর্ক! এমনকি ঢাকায় কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন অনেক সাবেক ভারতীয় কর্মকর্তার সঙ্গেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে শেখ হাসিনার সৌহার্দ্য আছে। বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে, গত ১০০ দিনের মধ্যে তার পুরনো পরিচিত এ ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে কেউ কেউ শেখ হাসিনার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা করারও সুযোগ পেয়েছেন। এ ধরনের ‘ভিজিটে’র সংখ্যা হাতেগোনা হতে পারে।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কতটা অবাধ : গত তিন মাসে শেখ হাসিনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কথিত ফোনালাপের বেশ কিছু অডিও ‘ভাইরাল’ হয়েছে যাতে একপক্ষের কণ্ঠস্বর হুবহু শেখ হাসিনার মতোই শোনায়। ভারত যদিও এসব ‘ফাঁস’ হওয়া অডিও নিয়ে সরকারিভাবে কোনো মন্তব্য করেনি, তবে একাধিক পদস্থ সূত্র একান্ত আলোচনায় স্বীকার করেছে, এগুলো বাস্তবিকই শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর। দিল্লির নর্থ ব্লকের এক কর্মকর্তা আবার বলছেন, এআই দিয়ে বানানো হয়েছে, নাকি শেখ হাসিনার নিজেরই গলা, আমি জানি না। তবে তার তো পরিচিতদের সঙ্গে কথাবার্তা বলায় কোনো বিধিনিষেধ নেই, এখন কেউ যদি সেই আলাপ রেকর্ড করে লিক করে দেয়, তাতে আমাদের কী করার আছে?

ভারতে কোনো কোনো পর্যবেক্ষক আবার ধারণা করছেন, শেখ হাসিনা যাতে নিজের দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়ে তাদের মনোবল ধরে রাখতে পারেন, সেজন্য দিল্লিই এসব কথাবার্তা হতে দিচ্ছে এবং পরে সুযোগ বুঝে তা ‘লিক’ও করে দিচ্ছে, যাতে তা যত বেশি সম্ভব লোকের কাছে পৌঁছতে পারে! এর আসল কারণটা যা-ই হোক, বাস্তবতা হলো শেখ হাসিনা ভারতে কোনো গৃহবন্দিও নন বা রাজনৈতিক বন্দিও নন- ফলে দেশে-বিদেশে পরিচিতদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগ তিনি পাচ্ছেন। ওই কর্মকর্তা আরো বলছিলেন, ভারতে যখন কোনো রাজনৈতিক নেতা গৃহবন্দি হন, তার বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের অধিকারও কার্যত কেড়ে নেয়া হয়!’ সুতরাং শেখ হাসিনা যে ভারতে মোটেই গৃহবন্দি নন- তার প্রমাণ তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিতই কথাবার্তা বলতে পারছেন। দিল্লিতে থাকা মেয়ে সাইমা ওয়াজেদ কিংবা ভার্জিনিয়াতে থাকা ছেলে সজীব ওয়াজেদের সঙ্গেও তার প্রায় রোজই যোগাযোগ হচ্ছে। নিউজ চ্যানেল, খবরের কাগজ বা ইন্টারনেটেও তার সম্পূর্ণ অ্যাকসেস আছে। তবে ৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের যে নেতাকর্মীরা পালিয়ে ভারতে চলে এসেছেন তাদের কারো কারো সঙ্গে শেখ হাসিনার যোগাযোগ হলেও তা কেউই সশরীরে (ইন পারসন) দলনেত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাননি। আর ভারতে বসে শেখ হাসিনা যাতে এখনই নিজের বয়ানে কোনো প্রকাশ্য রাজনৈতিক বিবৃতি না দেন, সে জন্যও তাকে ভারতের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে বিবিসি জানতে পেরেছে।

হাসিনার রাজনৈতিক পুনর্বাসন নিয়ে দিল্লি কী ভাবছে?

ভারত এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি কথাও বলছে না সঙ্গত কারণেই, তবে ঢাকায় এক সময়ে দায়িত্ব পালন করা ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী মনে করেন, এই কাজটা শুধু কঠিন নয়- খুবই কঠিন। কিছুদিন আগে ফাঁস হওয়া একটি অডিওতে শেখ হাসিনার মতো কণ্ঠস্বরে একজনকে বলতে শোনা গিয়েছিল, আমি (বাংলাদেশের) খুব কাছাকাছিই আছি, যাতে চট করে ঢুকে পড়তে পারি! গত সপ্তাহে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীও হয়তো ভাবছেন, তাদের নেত্রীর দেশে ফেরা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা! তবে শেখ হাসিনা এ মুহূর্তে যে দেশের আতিথেয়তায় আছেন, তারা কিন্তু এখনই এতটা আগ বাড়িয়ে ভাবছে না। সাউথ ব্লকের এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ক্রিকেটীয় উপমায় বলছিলেন, পিচ এখনও প্রতিকূল, বল উল্টাপাল্টা লাফাচ্ছে। এরকম সময় চালিয়ে খেলতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।