মহাকাশে ক্রমশ বাড়তে থাকা রকেট উৎক্ষেপণ ও মহাকাশ পর্যটন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বড় ক্ষতি করতে এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনেও নেতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে, এমনই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা। রিচার্ড ব্র্যানসন ও জেফ বেজোসের মতো মার্কিন ধনকুবেররা যখন নিজেদের কোম্পানি থেকে মহাকাশ পর্যটন ব্যবস্থা চালু করার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন তা গোটা বিশ্বের সিংহভাগ মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে, বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ বলছেন, এইসব মাইলফলক স্রেফ প্রযুক্তিগত অর্জন নয়, বরং অন্য কিছুরও প্রতিনিধিত্ব করে। মহাকাশে বাণিজ্যিক ফ্লাইট আলোর মুখ দেখতে বেশ কয়েক বছরের বিলম্ব ও বাধার মুখে পড়লেও, তা দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে নতুন যুগের সম্ভাব্য সূচনাকে চিহ্নিত করে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে প্রযুক্তি সাইট স্পেস ডটকম। এখন প্রায়শই বিভিন্ন রকেটকে বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তর দিয়ে ঘন ঘন উড়ে যেতে দেখা যায়।
উদাহরণ হিসেবে, ব্র্যানসনের কোম্পানি ভার্জিন গ্যালাক্টিকের তৈরি স্পেসপ্লেন ‘স্পেসশিপ টু’র ফ্লাইটগুলো পরিচালিত হয়েছে হাইব্রিড ইঞ্জিন দিয়ে, যা রাবার পোড়ায় ও ব্যাপক ধোঁয়ার মেঘ সৃষ্টি করে। ‘হাইব্রিড ইঞ্জিনে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে, এর ফলে সবসময়ই প্রচুর বর্জ্য তৈরি হয়,’ বলেছেন ইতালির ‘পলিতেকনিকো দে মিলানো’ ইউনিভার্সিটি’র অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফিলিপ্পো ম্যাগি, যিনি রকেটের প্রপালশন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করেন। এ ছাড়া, বেশ কয়েক বছর আগে হাইব্রিড রকেট ইঞ্জিন নির্গমন নিয়ে প্রকাশিত এক বিশদ বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করা গবেষণা দলের অংশও ছিলেন তিনি। ‘এইসব ইঞ্জিন অনেকটা মোমবাতির মতো কাজ করে। আর এদের প্রজ্বলনের প্রক্রিয়া থেকে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়, যা বর্জ্য তৈরির পেছনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।’
মহাকাশবিষয়ক পরামর্শক সংস্থা ‘নর্দার্ন স্কাই রিসার্চ’র প্রধান বিশ্লেষক ডালাস কাসবস্কি’র মতে, পৃথিবীর কক্ষপথে ভার্জিন গ্যালাক্টিকের একেকেটি স্পেস ট্যুরিজম ফ্লাইট সম্পন্ন হতে সময় লাগে প্রায় দেড় ঘণ্টা, যা আটলান্টিকের ওপর দিয়ে ১০ ঘণ্টা ফ্লাইট পরিচালনার সমান দূষণ সৃষ্টি হতে পারে। ‘মহাকাশ পর্যটন বাজারের পরিসর অন্যান্য পর্যটন শিল্পের তুলনায় কম হলেও এ খাতের একেকটি ফ্লাইট পরিচালনায় অনেক পরিশ্রম করতে হয়, যা একটি সম্ভাব্য সমস্যা,’ স্পেস ডটকম’কে বলেন কাসাবস্কি। তবে, এক্ষেত্রে শুধু ভার্জিন গ্যালাক্টিকের রকেট নয়, বরং হাইড্রোকার্বন জ্বালানী থেকে বর্জ্য তৈরি করা সকল রকেটই সমান দায়ী। অতীতে নাসার স্পেস শাটলে ব্যবহার করা রকেট ইঞ্জিনগুলোতে বিভিন্ন ধাতব উপাদান পোড়ানো হতো ও এর থেকে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের সঙ্গে অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের কণা নির্গত হতো।
উভয়ক্ষেত্রেই তা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলত। অন্যদিকে, ব্লু অরিজিনের বাণিজ্যিক রকেট ‘নিউ শেফার্ড’ পরিচালিত হয় ‘বিই-৩’ নামের ইঞ্জিন দিয়ে, যেখানে রকেটের ‘থ্রাস্ট’ তৈরির জন্য তরল হাইড্রোজেন ও তরল অক্সিজেনের সমন্বয় ঘটানো হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্যান্য রকেট ইঞ্জিনের তুলনায় বিই-৩’তে এত বড় মাপের দূষণ সৃষ্টি হয় না। এর থেকে মূলত পানি ও কয়েকটি ছোটখাট দাহ্য উপাদান বের হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা ‘ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নোয়া)’র ‘কেমিক্যাল সায়েন্সেস ল্যাবরেটরি’তে কাজ করা জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ক্যারেন রোজেনলফ বলছেন, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, রকেটগুলো স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের মতো বায়ুমণ্ডলের ওপরের বিভিন্ন স্তর দূষিত করছে, যার শুরু সমুদ্রপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার উচ্চতা থেকে। এমনকি মেসোস্ফিয়ার, যার উচ্চতা ৫০ কিলোমিটার, সেক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে থাকে।
‘আপনি এমন জায়গায় দূষণ ছড়াচ্ছেন, যেখানে সাধারণত নির্গমন ঘটতে দেখা যায় না,’ স্পেস ডটকম’কে বলেন রোজেনলফ। ‘আমাদের সত্যিই বুঝতে হবে, আমরা যদি এ প্রবণতা বাড়াতে থাকি, তবে এর সম্ভাব্য ক্ষতিগুলো কী কী?’ রোজেনলফের সঙ্গে প্রায়শই কাজ করা অলাভজনক সংস্থা ‘অ্যারোস্পেস কর্পোরেশন’-এর বায়ুমণ্ডলবিষয়ক বিজ্ঞানী মার্টিন রসের মতে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে রকেট উৎক্ষেপণের প্রভাব এখনও পর্যন্ত সহনীয় পর্যায়ে আছে। কিন্তু, এর কারণ হল মহাকাশে এত বেশি রকেট উৎক্ষেপণ হয় না। ‘মহাকাশ খাতে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ জ্বালানী পোড়ানো হয়, তা এভিয়েশন খাতের এক শতাংশেরও কম,’ স্পেস ডটকমকে বলেন রস। ‘তাই এটি নিয়ে অত বেশি গবেষণা না হওয়ার বিষয়টিও যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। কিন্তু প্রেক্ষাপট এমনভাবে বদলে যাচ্ছে যে আমাদের উচিৎ, এ বিষয়ে আরও বিস্তারিতভাবে শেখা।’ নর্দার্ন স্কাই রিসার্চণ্ডএর অনুমান বলছে, এ দশকজুড়ে মহাকাশ পর্যটনের জন্য রকেট ব্যবহারের ঘটনা বেড়ে যাবে, যেখানে বছরে এখন সম্ভবত ১০টি ফ্লাইট পরিচালিত হলেও অদূর ভবিষ্যতে অর্থাৎ ২০৩০ সাল নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়াতে পারে বছরে ৩৬০টি’তে। তবে, মহাকাশ পর্যটন বৃদ্ধির হার নিয়ে ভার্জিন গ্যালাক্টিক ও ব্লু অরিজিনের মতো কোম্পানিগুলো যে লক্ষ্য নিয়েছে, তার চেয়ে অনেক কম সংখ্যা উঠে এসেছে এ অনুমানে। ‘মহাকাশ পর্যটনের চাহিদা অনেক বেশি,’ বলেন কাসাবস্কি। ‘এইসব কোম্পানির ভার্চুয়াল গ্রাহকরা মহাকাশে যেতে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। তাই তারা চান, এর পরিসর যেন বেড়ে যায়। এমনও হতে পারে, তারা স্বল্প দূরত্বে পরিচালিত প্লেনগুলোর মতো দিনে একাধিকবার ভ্রমণ করতে চান।’ এখন পর্যন্ত, বায়ুমণ্ডলে রকেট উৎক্ষেপণের বিভিন্ন রাসায়নিক প্রভাব সরাসরি পরিমাপ করা গেছে স্পেস শাটল যুগ থেকে। ৯০-এর দশকে, ওজোন স্তরের ক্ষতি ঠেকানোর লক্ষ্যে গোটা বিশ্বকে একজোট হতে দেখা গেছে, যখন নাসা, নোয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের এয়ার ফোর্স মিলে একটি প্রচারণা চালায়।