সুসংবাদ প্রতিদিন : তিস্তার চরাঞ্চলে চাষাবাদ
ফসল উৎপাদনের বাম্পার ফলনের আশায় চাষিরা
প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আব্দুর রহমান মিন্টু, রংপুর
রংপুর বিভাগে ৫ জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রমত্তা তিস্তায় কয়েক মাস অথৈ পানি ছিল। এখন সেই পানি শুকিয়ে যাওয়ায় তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে চর। যেদিকে দুচোখ যায় শুধু ধু-ধু বালুচর। এ বছরে প্রায় ৭০০ থেকে ১০০০ কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হয় এই চরাঞ্চলে।
জানা গেছে, তিস্তা নদীটি নীলফামারী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। জেলাগুলো হচ্ছে রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা। জেলার তিস্তা নদীর দৈর্ঘ ১২৮ কিমি.। এই নদীর জেগে ওঠা বালুচরে স্থানীয় কৃষকরা আলু, মিষ্টি আলু, পেঁয়াজ, রসুন, সিম, মিষ্টিকুমড়া, বাঁধাকপি, ফুলকপি, সিম, বাদাম, কাউন, ভুট্টা, গম, সরিষা, সকোয়াস, ষ্ট্রবেরিসহ ৩২ প্রকার ফসল রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ব্যাপক পরিসরে তিস্তার চরে চাষাবাদ হওয়ার ফলে কর্মসংস্থান হয়েছে অনেক পুরুষ ও নারী শ্রমিকের। কেননা কৃষি সেক্টর ছাড়া তেমন কোনো কাজের সুযোগ নেই এসব চরাঞ্চলে।
কৃষকরা বলেছেন, এ বছর বন্যায় ভারত থেকে পানির সঙ্গে কাঁদা পানি আসার ফলে তিস্তা নদীর বালু মাটিতে পলি জমেছে। ফলে এসব জমিতে বিভিন্ন আবাদ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন তারা। সরেজমিন কথা হয়, কৃষক আমিনুল ইসলামের সাথে তিনি বলেন, আমার নিজস্ব জমি নেই। আমি ৭ মাসের জন্য ৬ একর জমি বর্গা নিয়েছি এখন আলু চাষ করেছি, আলু তুলে বাদাম গারবো। জমির মালিককে ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে যাবতীয় খরচ হিসাব নিকাশ করে যা লাভ হবে তাতেই সন্তুষ্ট। শাহিদা বেগম বলেন, ১ একর জমি বন্দক নিয়ে আলু চাষ করেছি আশা করি এবার ভালো ফলন পাবো। বালুচরে স্যালো মেসিন দিয়ে পানি নেয়া লাগে, কামলা কিশান সব বাদ দিয়ে যা লাভ হয় তাতেই সন্তুষ্ট। বিদ্যানন্দ ইউনিয়নে চরে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবু তাহের বলেন, আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা এ চরে নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫০হেক্টর জমিতে। আলুর পাশাপাশি কৃষকরা মিষ্টিকুমড়ার আবাদ করে স্বাবলম্বী হওয়ার আশা করছেন। তবে এখনো পেঁয়াজ ও রসুনের পরিসংখ্যান হাতে পায়নি। তিস্তার চরে কাজ করতে এসেছেন আলেয়া বেগম (৪০) নামের এক নারী। তিনি বলেন, সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত কাজ করলে মজুরি পাই ২০০ টাকা। পুরুষরা পান ৪০০ টাকা। মজুরিটা একটু বেশি হলে ভালো হতো। আলু গাড়ার সময় নিয়মিত কাজ করছি এ কারণে সংসারে একটু অভাব কমেছে। এইরকম কাজ সারাবছর থাকলে, আমার মত পরিবারগুলোর অনেক ভালো হতো। ঘোড়ার গাড়ি চালক কেরামত আলী বলেন, পুরোদমে কাজ চলছে তিস্তার চরে। জমিতে আমরা বিভিন্ন মালামাল পরিবহন করছি। সেখানে তো অন্য কোনো গাড়ি যায় না। তাই ঘোড়ার গাড়ি ভরসা। আমার কাজেরও ব্যস্ততা বেড়েছে। নিয়মিত এমন কাজ থাকলে, আয়টা ভালো হতো। পাইকারপাড়া মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষক জাহেরুল হক বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে আমাদের উত্তর অঞ্চলের কৃষিপণ্য বিভিন্ন এলাকায় আমদানি হবে। রাজারহাট উপজেলার অতিরিক্ত কৃষি অফিসার হৈমন্তী রানী বলেন, আমাদের কৃষকরা শীতকালীন আলু, সরিষা, পেঁয়াজ, রসুন ও মিষ্টিকুমড়া রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এদিকে আগাম অনেক শাকসবজিও পাওয়া যায়। যেহেতু কৃষকরা দাম ভালো পায়, তাই একটু বেশি পরিসরে আবাদে করার জন্য উৎসাহী হচ্ছেন। গত ছয় বছর ধরে রংপুর জেলার তিস্তা বেস্টিত তিন উপজেলার কাউনিয়া, পীরগাছা ও গংগাচড়া অনাবাদি প্রায় ৮ হাজার হেক্টর ধু-ধু বালুচরে এখন সবুজের বিপ্লব। চরের জমিতে এখন চাষ হচ্ছে- আলু, মিষ্টি কুমড়া, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, স্কোয়াস, ওলকপি, গম, বাদম, ভুট্টাসহ নানা ধরনের ফসল। তপ্ত বালুচরে সবজির আবাদ করে কৃষকরা দেখছেন অর্থনৈতিক মুক্তির পথ।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, তিস্তার চরসহ জেলার প্রায় ৮ হাজার হেক্টর চরের জমি এখন আবাদ যোগ্য হয়েছে। এর মধ্যে চলতি মৌসুমে প্রায় ৬ হাজার হেক্টর চরের জমিতে বাদামসহ সবজি জাতীয় ফসল চাষাবাদ এখন মধ্যম সময়ে রয়েছে। বছরে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হয় এই চরাঞ্চলে। সরেজমিন কাউনিয়া উপজেলার তিস্তা সেতু এলাকা, তালুক শাহবাজ, চরগনাইসহ বিভিন্ন চর ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি চরেই কৃষকরা বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কাক ডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চরে কাজ করেন কৃষক-কৃষানি। তিস্তা চরের বালু মাটি যেন সাদা সোনায় পরিণত হয়েছে তাদের জন্য। বর্তমানে নদীতে পানি কমে যাওয়ায় নদীভিত্তিক জীবিকা নির্বাহকারীরা পলি ও দোআঁশ মাটিতে চাষাবাদ করে নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করে তুলছেন। উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের গোপিডাঙ্গা, আরাজি হরিশ্বর, গদাই চর, পাঞ্জরভাঙ্গা, তালুকশাহবাজ, ঢুসমারা চর, টেপামধুপুর ইউনিয়নের হরিচরনশর্মা, গানাই, চরগনাই, বিশ্বনাথ চর, আজমখাঁ চর, হয়বতখাঁ চর, শহীদবাগ ইউনিয়নের প্রাণনাথচর, হারাগাছ ইউনিয়নের নাজিরদহ চরসহ বিভিন্ন চরে গিয়ে দেখা গেছে, খরস্রোতা তিস্তায় জেগে ওঠা বালু চরের পলি ও দোআঁশ মাটিতে চাষ হচ্ছে আলু, ভুট্টা, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, মিষ্টি কুমড়াসহ নানা জাতের ফসল। ফসল পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা।
তিস্তা সেতু এলাকায় চরের খেত পরিচর্যা করা কৃষক নিমাই চন্দ্র জানান, চরে আলু, পেঁয়াজ ভুট্টা, মরিচ, লাউ চাষ করেছি। ফলনও ভালো হয়েছে। আশা করছি দামও ভালো পাবো। তালুক শাহবাজ চরের কুশড়া চাষি তোতা মাস্টার, সাইফুল ও স্বাধীন জানান, গত বছর মিষ্টি কুমড়ার দাম বেশি পাইনি। এবার আশা করছি ভালো দাম পাওয়ার। আবহাওয়া ভালো থাকলে ফলন ভালো হবে। এই তিস্তা চরে আবাদ করে আমাদের নদীপাড়ের মানুষের সংসার চলে। চাষাবাদের জন্য তেমন কোনো জমি নেই আমাদের। তাই প্রতিবছর নদীতে চর জাগলে চাষাবাদ করি।’
কাউনিয়া উপজেলার চরাঞ্চলের প্রায় ২০২ হেক্টর জমিতে কুমড়াসহ নানা জাতের ফসল চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চরের কৃষকদের কৃষি বিভাগ থেকে ও উপজেলা পরিষদ থেকে সার্বিক সহযোগিতাসহ ২৫০ কৃষককে বিভিন্ন ধরনের সার দেয়া হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ফলন ভালো হবে। তিস্তার নদীর জেগে ওঠা চরকে ঘিরে নদী পাড়ের মানুষের ভাগ্যের দুয়ার খুলেছে। চলতি মৌসুমে তারা সবজির বাম্পার ফলনের পাশাপাশি ও দাম ভালো পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মো. ওবায়দুর রহমান মণ্ডল জানান, চলতি মৌসুমে ৫ জেলারসহ তিস্তার চরাঞ্চলে নানা রকমের ফসল ও সবজি আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে শীত মৌসুমের সবজি জাতীয় ফসলের বাম্পার ফলনে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যার ফলে চরের কৃষকের দ্বিগুণ ফলন হবে বলেও আশা করা যাচ্ছে। কৃষকদের প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন সরকারি ছাড়াও বেসরকারি সংস্থাগুলো কৃষকদের প্রতিবছর কৃষি প্রণোদনা দিয়ে আসছেন। তিনি আরো জানান, দিন দিন চরে চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়ছে। ফলে অনেক কৃষক বালুচরে সবজি উৎপাদন করে নিজেদের স্বাবলম্বী করে তুলছেন।