অনেক ঝড়-ঝাপ্টার পর অবশেষে লেবাননে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। এই বিরতির আওতায় দেশটি থেকে ইসরায়েলি সেনা ও হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের প্রত্যাহারের পর দক্ষিণাঞ্চলে লেবানিজ সামরিক বাহিনী মোতায়েনের কথা রয়েছে। যুদ্ধে সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তাই যুদ্ধবিরতির পর এর ভবিষ্যৎ কী হবে এ নিয়ে প্রশ্ন জাগছে অনেকের মনে। এই প্রশ্ন ধরেই একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির বৈরুত প্রতিবেদক হুগো বাচেগা। অন্ধকারাচ্ছন্ন গাড়ি ভর্তি রাস্তা। জিনিসপত্র বোঝাই ব্যাগ নিয়ে হেঁটে চলে গেছেন অনেকে। তারা ঠিক কোথায় যাচ্ছেন তা নিশ্চিত নয়। তবে এখানে যে তারা থাকতে পারবেন না তা নিশ্চিত। গত মঙ্গলবার ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এই অঞ্চলগুলোর জন্য প্রথম স্থানান্তর সতর্কতা জারির কিছুক্ষণ পরই মধ্য বৈরুতের নুওয়েরিতে এই দৃশ্য দেখা যায়। কয়েক ঘণ্টা আগে বিকেলের আমরা ইসরায়েলি বিমান হামলার স্থানটি দেখার চেষ্টা করছিলাম, যে হামলাটি কোনো সতর্কতা ছাড়াই করা হয়েছিল। হামলায় একটি বিল্ডিং ধূলিতে মিশে যায় এবং এতে অন্তত সাতজন নিহত হন। তবে আমরা সেখানে যেতে পারিনি। ভিড় চলে যাচ্ছিল এবং মোটরবাইকে আরোহণকারীরা আমাদের এখানে চলাফেরা করতে বাধা দেয়। তারা বলছিল, এটি নিরাপদ নয়। এর কয়েক মিনিট পর আমরা আরো বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। এরপর, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে এভাবেই রাত কাটল বৈরুতে। একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ: কয়েকটি দূরে, বাকিগুলো কাছাকাছি কোথাও।
মাথার উপর ইসরায়েলি ড্রোনের অবিরাম শব্দ সঙ্গে গুলির শব্দ মিশে মানুষ আরও সতর্ক হয়ে নিরাপত্তার সন্ধানে ছুটতে বাধ্য করেছে। এই নাটকীয় বৃদ্ধি এমন সময় ঘটে যখন লেবানন যুদ্ধবিরতি চুক্তির নিয়ে ইসরায়েলি সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছিল। শক্তিশালী ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহর সঙ্গে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সংঘাতের অবসানের একমাত্র আশা ছিল এই যুদ্ধবিরতি। আর সেই অপেক্ষার সময়টাতেই ইসরায়েল বৈরুতে তার সবচেয়ে তীব্র বোমা হামলাটি করে।
দুই মিনিটের মধ্যে নুওয়েরিতে হামলার পরপরই যুদ্ধবিমানগুলো শহরের দক্ষিণ উপকণ্ঠে হিজবুল্লাহর ২০টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে, যা দাহিহ নামে পরিচিত। ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) বলেছে, লক্ষ্যবস্তুগুলো হিজবুল্লাহর ব্যবহৃত স্থাপনাগুলোকে আঘাত করেছে ও শহরজুড়ে সিরিজ আক্রমণ হয়েছে। এখন অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে একটি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছে। তবে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। যুদ্ধটি লেবাননের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে এনেছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে শত্রুতা শুরু হওয়ার পর থেকে দেশটিতে ৩ হাজার ৭০০জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং হিজবুল্লাহর শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে এমন অঞ্চলে ১০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বিশ্বব্যাংক পরিমাণ ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে অনুমান করেছে। এই ক্ষতি পুনরুদ্ধারে সময় লাগবে এবং কে এর জন্য অর্থ প্রদান করবে তা কেউ জানে না। চুক্তির আওতায় লেবানন থেকে ইসরায়েলি বাহিনী ও হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের প্রত্যাহারের পর, দক্ষিণে হাজার হাজার লেবানিজ সেনা মোতায়েন করা হবে। কীভাবে তাদের মোতায়েন করা হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়।
সামরিক বাহিনী অভিযোগ করেছে, লেবাননের ক্ষয়ক্ষতি পূরণের জন্য তাদের কাছে অর্থ, জনবল ও সরঞ্জামের মতো সম্পদ নেই। তবে প্রশ্ন শুধু তহবিলের নয় যা সম্ভবত লেবাননের কিছু আন্তর্জাতিক মিত্রদের কাছ থেকে আসবে। প্রশ্ন হলো, প্রয়োজনে লেবাননের সামরিক বাহিনী কি হিজবুল্লাহর মুখোমুখি হবে? এমনটি হলে এটি হবে লেবানিজদের বিরুদ্ধে লেবানিজদের দাঁড় করানোর মতো, যা সাম্প্রদায়িক বিভাজন গভীর এমন একটি দেশে সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ। একজন কূটনীতিক আমাকে বলেছেন, লেবাননের কর্তৃপক্ষ মনে হয় মেনে নিয়েছে যে, পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়া দরকার। আর তা করার জন্য তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
হিজবুল্লাহও বিধ্বস্ত হয়েছে। দীর্ঘদিনের প্রধান হাসান নাসরুল্লাহসহ গোষ্ঠীটির অনেক সিনিয়র নেতা নিহত হয়েছেন। অবকাঠামোগত ক্ষতিও কম নয়। যুদ্ধ পরবর্তী হিজবুল্লাহ কেমন হতে যাচ্ছে এটিও আরেকটি অজানা বিষয়।
সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটি মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ অবশ্য বলবেন অপদস্ত হয়েছে। হিজবুল্লাহর বিরোধীরা খুব সম্ভবত এটিকে গোষ্ঠীটির প্রভাব সীমিত করার সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাবে। সংঘাতের আগে তারা হিজবুল্লাহকে প্রায়ই লেবানন রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি রাষ্ট্র হিসেবে বর্ণনা করত। কয়েক মাস ধরে হিজবুল্লাহর সমর্থনকারী ঘাঁটির বাইরের মানুষজন বলছিল, গোষ্ঠীটি দেশকে এমন একটি যুদ্ধে টেনে নিয়েছে যা জণগণের স্বার্থে ছিল না। এই যুদ্ধচুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে বিরোধের অবসান ঘটলেও লেবাননে নতুন অভ্যন্তরীণ সংঘাত শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই।