সুসংবাদ প্রতিদিন
শেরপুরের ছানা জিআই পণ্যের মর্যাদা অর্জন
প্রকাশ : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মো. মোশারফ হোসাইন, নকলা (শেরপুর)
গুঁটিগুঁটি মিষ্টি জাতীয় সুস্বাধু রসালো খাদ্যের নাম শেরপুরের ছানার পায়েস। ছানার পায়েস শেরপুরের একটি প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী খাবার। বিচিত্র খাবারের মধ্যে শত বছরের সুখ্যাতি আছে এ পায়েসের। যেকোনো উৎসব আয়োজনে ভোজন রসিক বাঙালির খাদ্য তালিকায় ছানার পায়েস বিশেষ ঐতিহ্য বহন করে। দুগ্ধজাত এ খাবার সব বয়সের লোকের পছন্দ। দেশজুড়ে শেরপুরের ছানার পায়েসের কদর রয়েছে। প্রবাসীদের বদৌলতে দিন দিন বিদেশেও এই পায়েসের চাহিদা বাড়ছে। ছানার পায়েসের কারিগররা জানান, দুগ্ধজাত এ খাবারটি তৈরি করতে খাঁটি দুধ, চিনি, সামান্য পরিমাণ ময়দা ও এলাচ লাগে। স্বাভাবিক কারণেই এর স্বাদটা একটু ভিন্ন, চাহিদাও ব্যাপক। তারা বলেন, এককেজি ছানার পায়েস তৈরিতে ২ কেজি খাঁটি দুধ, আধাকেজি চিনি, সামান্য পরিমাণ ময়দা ও অন্তত ১৫ গ্রাম এলাচ লাগে। জনশ্রুতি আছে, শত বছর আগে জেলার ঘোষপট্টিতে প্রথম ছানার পায়েস তৈরি করা হয়। সে সময়কার জমিদাররা ঘোষপট্টির বানানো ছানার পায়েস বিশেষ পদ্ধতিতে নিয়ে যেতেন কলকাতায়। এছাড়া আত্মীয়-স্বজন কিংবা জমিদারের কাছে উপঢৌকন হিসেবেও এ পায়েস পাঠানো হতো। বিয়ে, জন্মদিন, ঈদ, পূজাসহ যেকোন অনুষ্ঠানে অতিথি আপ্যায়নে ছানার পায়েসের সুখ্যাতি রয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শেরপুরে ঘুরতে গিয়ে সেখানকার ছানার পায়েস খাননি এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন। ছানার পায়েস না খেলে শেরপুর ভ্রমণ যেন পরিপূর্ণতা পায় না। প্রতিকেজি ছানার পায়েস ৩৮০ থেকে ৪২০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। জন্মদিন, ঈদ, বিয়েসহ বিভিন্ন পার্টিতে ছানার পায়েসের প্রচুর অর্ডার আসে বলে জানান শেরপুর শহরের নিউমার্কেট মোড়ের অনুরাধা মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বতাধিকারী বাপ্পি দে। স্থানীয়রা জানান, কোনও শুভ কাজে মিষ্টিমুখ করানো বাঙালি সংস্কৃতি। বিয়েসহ জন্মদিন, ঈদ, পূজা বা এধরনের যেকোনো উৎসব আয়োজনে অতিথি আপ্যায়নে ছানার পায়েসের মর্যাদা সবার ওপরে। যেকোন উৎসব বা অনুষ্ঠান ছানার পায়েস ছাড়া যেন জমেই না। বর্তমানে শেরপুর শহরের অনুরাধা মিষ্টান্ন ভান্ডার, দুর্গাচরণ মিষ্টান্ন ভান্ডার, প্রেমানন্দ গ্রান্ড সন্স, অমৃত গোপাল মিষ্টান্ন ভান্ডার, নন্দ গোপাল মিষ্টান্ন ভান্ডার, চারু সুইটস, শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার, বল্লভ মিষ্টান্ন ভান্ডার ও মা ভবতাঁরা মিষ্টান্ন ভান্ডারসহ সদর উপজেলার অন্তত ২০টি দোকানে এই মিষ্টি তৈরি ও বিক্রি করা হয়। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০০ কেজি ছানার পায়েস বিক্রি হয় বলে তারা জানান।
গুণে ও মানে অনন্য শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন শেরপুরের ছানার পায়েসকে ভৌগোলিক নির্দেশক নিবন্ধন (জিআই) পণ্য হিসেবে ৫ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মুনিম হাসান-এঁর স্বাক্ষরিত নিবন্ধন সনদ প্রদান করা হয়েছে। শেরপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ২ ডিসেম্বর জিআই পণ্যের মর্যাদা অর্জন করে শেরপুরের ছানার পায়েস। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভৌগোলিক নির্দেশক ইউনিট ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন, ২০১৩ বিধি-২৮(১) মোতাবেক এই নিবন্ধন দেওয়া হয়। যার নিবন্ধন সনদ নম্বর জিআই-৫৬ এবং ভৌগোলিক নির্দেশক নম্বর ৮৮। ‘আওয়ার শেরপুর’-এর প্রতিষ্ঠাতা মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, মিষ্টি দেখলে কার না খেতে লোভ জাগে? আর তা যদি হয় শেরপুরের বিখ্যাত ছানার পায়েস তাহলেতো কথাই নেই। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার প্রসিদ্ধ মিষ্টির মধ্যে শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী ছানার পায়েস অন্যতম। তিনি জানান, শীতকালে পর্যটনসমৃদ্ধ শেরপুরে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুলসংখ্যক পর্যটক পর্যটন কেন্দ্র গারো পাহাড়ের গজনী অবকাশ কেন্দ্র, মধুটিলা ইকোপার্ক, রাজার পাহাড়, পানিহাতা, অর্কিড গার্ডেন ও রাবার বাগানসহ বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে এসে ছানার পায়েসের স্বাদ নিতে ভুলেন না। ঘুরতে আসা প্রায় সবাই শেরপুরের ছানার পায়েস সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। শেরপুরের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি জাতীয় খাবার হিসেবে ছানার পায়েসের স্থান সবার উপরে। দেশে-বিদেশে এর কদর দিন দিন বাড়ছে বলে দেলোয়ার হোসেন জানান।
দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বিখ্যাত খাবারের দেশ-বিদেশে পরিচিতির লক্ষে ৪ মে (বৃহস্পতিবার) থেকে ৬ মে (শনিবার) পর্যন্ত ‘বাংলাদেশ ফুড ফেস্টিভাল : টেস্ট অফ বাংলাদেশ’ নামে এক বিশেষ মেলা হয় রাজধানী ঢাকার বনানী কামাল আতাতুর্ক পার্কে। এর মাধ্যমে সারা বিশ্বের পর্যটকদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে এই কান্ট্রি ব্রান্ডিং একটি অসাধারণ আয়োজন ছিল। ওই মেলায় ৩৯টি পণ্যের মধ্যে শেরপুরের ছানার পায়েস ও জেলা ব্র্যান্ডিং পণ্য তুলশীমালা চালের আলাদা দুটি স্টল নিয়ে অংশগ্রহণ করে প্রতিনিধি দল। শেরপুরের এই পণ্য দুইটি রাজধানীবাসীসহ মেলায় বিভিন্ন খাবারের স্বাদ নিতে আসা দেশ-বিদেশের দর্শকদের নজর কাড়ে। শেরপুরের ছানার পায়েস ও জেলা ব্র্যান্ডিং পণ্য তুলশীমালা চালের কদর ছিল আকাশচুম্বী।
তিনি জানান, একই মাঠে সারাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও বিখ্যাত খাবারের সমাহার থাকায় বিভিন্ন খাবারের স্বাদ নিতে আসা রাজধানীবাসীসহ দেশ-বিদেশের দর্শকদের মন ছোঁয়ে যায়। তখনকার বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেনের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপি এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহির মুহাম্মাদ জাবের। টেস্ট অফ বাংলাদেশ সম্পর্কে বিস্তারিত বক্তব্য রাখেন সাদেকুল আরেফিন। এই মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠান ও মেলায় বসানো স্টলসমূহ পরিদর্শনের জন্য বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতগণকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ওই মেলা থেকেই শেরপুরের ছানার পায়েসের পরিচিতি ও কদর কয়েকগুণ বেড়ে যায়। যা শেরপুরের ছানার পায়েসকে ভৌগোলিক নির্দেশক নিবন্ধন (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্তি একধাপ এগিয়ে যায়।
ফলশ্রুতিতে চলতি মাসের তথা ডিসেম্বরের ২ তারিখে জিআই পণ্যের মর্যাদা অর্জন করে শেরপুরের ছানার পায়েস। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভৌগোলিক নির্দেশক ইউনিট ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন, ২০১৩ বিধি-২৮(১) মোতাবেক এই নিবন্ধন দেওয়া হয়। আর নিবন্ধন সনদ দেওয়া হয় ৫ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। সনদ পাওয়ার সংবাদটি জানাজানি হলে শেরপুর শহরে ছানার পায়েস বিতরণের হিড়িক পরে যায়।
আওয়ার শেরপুর এর প্রতিষ্ঠাতা ও স্বত্বাধিকারী মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘ছানার পায়েস শেরপুরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। জিআই পণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় আমরা আনন্দিত। এটি শেরপুরে ব্র্যান্ডিং ও ঐতিহ্য আরও বহুদূর নিয়ে যাবে।’
জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, শেরপুরের ছানার পায়েস দেশের ৪৪তম জিআই পণ্যের মর্যাদা অর্জন করেছে। আমরা বৃহস্পতিবার সনদের কপি হাতে পেয়েছি। জিআই পণ্য হওয়ার কারণে তা সারাদেশে ছড়িয়ে যাবে।’ তিনি আরো বলেন, শেরপুরের সম্ভাবনায় অন্যান্য সকল পণ্যের জিআই স্বীকৃতি চেয়ে শিগগিরই প্রস্তাব করা হবে।