মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নানান পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তারপরও কমছে না নিত্যপণ্যের দাম। লাফিয়ে লাফিয়ে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি ক্রেতাদের আয়। ফলে নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন ক্রেতারা। বাজারে অর্থের প্রবাহ কমাতে নীতি সুদহার (রেপো রেট) ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদহারও সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ চাহিদা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার যে লক্ষ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারণ করেছিল, সেটি কাজে আসেনি। উল্টো চলতি বছরের নভেম্বর মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ।
এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পণ্যের বাজার ও সরবরাহে পুলিশিং ব্যবস্থা জোরদারের মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। উৎপাদক থেকে শুরু করে ক্রেতার হাতে নিত্যপণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত এ ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। পাশাপাশি ছোট বা খুচরা বিক্রেতাদের বিরক্ত না করে যারা বাজারে সরাসরি প্রভাব বিস্তার করেন সেসব রাঘববোয়ালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে পলিসি সহজ করতে মতামত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। যেন তরুণরাসহ সবাই বাজারে (ব্যবসা-বাণিজ্যে) প্রবেশ করতে পারেন এবং বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতা থাকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে মূল্যস্ফীতিতে ১৬ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে চলতি বছরের জুলাই মাসে। এ মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয় ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাইয়ে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। বিবিএসের সবশেষ তথ্য বলছে, নভেম্বরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এ মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এর আগে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে ২০০৫-০৬ কে ভিত্তিবছর ধরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ঠেকেছিল ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। ওই বছর খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৭২ শতাংশে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে পালিয়ে যান টানা দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতারা। গণঅভ্যুত্থানের পর সবার প্রত্যাশা ছিল দেশে নিত্যপণ্যের বাজারে চাঁদাবাজি বন্ধ হবে, কমবে জিনিসপত্রের দাম। তবে জনগণের সে প্রত্যাশা পূরণের কোনো লক্ষণ এখনো দৃশ্যমান হয়নি। নিত্যপণ্যের দাম কমার পরিবর্তে বেড়েছে হু হু করে। সরকারের এত পদক্ষেপের পরও কেন নিত্যপণ্যের দাম কমছে না? এমন প্রশ্ন ছিল অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের কাছে।
তিনি বলেন, ‘নানান কারণে মূল্যস্ফীতি কমছে না* এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশে বড় বন্যা গেল, উৎপাদনেরও ঘাটতি আছে। শাক-সবজির ঘাটতি আছে। এখন এসবের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। গুদামে যা ছিল ফুরিয়ে যাচ্ছে। তবে এটা দিয়ে সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা হবে না। যেই কৌশলে খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করা হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম একটা মুদ্রানীতি। যাতে করে খাদ্যের ক্ষেত্রে স্থিতিশীল বাজার রাখতে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু চাল ডালের দাম কমানো কঠিন। বাজার যেভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে এটা ব্যর্থ কৌশল। বাজার মনিটরিংয়ের নামে পুলিশিং করা হচ্ছে, এটা দিয়ে হবে না।’
জাহিদ হোসেন আরো বলেন, ‘সরকার দাম নির্ধারণ করে সেটা ধরে রাখার চেষ্টা করছে, এতে কাজ হবে না। যেখানে পুলিশিং দরকার সেখানে হচ্ছে না। বাজার ব্যবস্থায় সপ্লাই চেইনে চাঁদাবাজির সমস্যা, এখানে পুলিশিং করলে কাজে আসবে। চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। খুচরা পর্যায়ে (খুচরা বিক্রেতা) হুমকি-ধামকি দিলে হিতে বিপরীত হয়। খুচরা ব্যবসায়ীরা বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখেন না। বাজারে কারসাজি করেন বড় খেলোয়াড়। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের লোকজন দিয়ে বকাঝকা করে ফাইন ধরিয়ে দিয়ে আর গলাবাজি করে বাজার বশে আনা যায় না। বাজারে স্বচ্ছতা বাড়ানো জরুরি। চাল, ডাল, গম, ভোজ্যতেল, চিনি সরবরাহ পর্যায়ে কী পরিমাণ লেনদেন হচ্ছে এখানে স্বচ্ছতা আনতে হবে। এগুলো জানার সহজব্যবস্থা থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘নতুন ব্যবসায়ীদের বাজারে ঢোকার প্রতিযোগিতা হচ্ছে না। বাজারে প্রতিযোগিতার জায়গা মসৃণ করতে হবে। যাতে যারা নতুন ব্যবসায়ী তারা যেন সহজে বাজারে ঢুকতে পারেন। এসব প্রতিযোগিতার পথ মসৃণ ও স্বচ্ছতা জরুরি। বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে সরকার কর কমিয়েছে, বাজারে এর প্রভাব কতটা হলো তা দেখতে হবে। যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন তাদের ধরতে হবে। আমদানির পথ উন্মুক্ত করা মানে প্রতিযোগিতার বাজার উন্মুক্ত করা। বাজার সবার জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।’
শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান ঘুরে দাঁড়ালেও পারছে না বাংলাদেশ : গণবিক্ষোভের মুখে দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কার গোতাবায়া রাজাপাকসে সরকারের পতন হয়। ওই সময়ে দেশটিতে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতির হার ঠেকেছিল প্রায় ৭০ শতাংশে। গত বছরের সেপ্টেম্বরের পর থেকে এখন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি নয়, মূল্যসংকোচনের ধারায় রয়েছে দেশটি। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কার বাজারে পণ্যের দাম না বেড়ে উল্টো কমছে। সবশেষ নভেম্বরে এসে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল ঋণাত্মক ২ দশমিক ১০ শতাংশ। কয়েক বছর ধরে চরম অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান।
রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা না ফিরলেও চলতি বছরে এসে অর্থনৈতিকভাবে বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশটি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় সাফল্যের দেখা পেয়েছে পাকিস্তানও। নভেম্বরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ, যা সাড়ে ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত বছরের এপ্রিলে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান সফল হলেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, নভেম্বরে দেশের মূল্যস্ফীতি আরও বেড়েছে। অক্টোবরে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত মাসে (নভেম্বরে) তা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে। এ মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ শতাংশে। বিবিএসের এ তথ্য আমলে নিলে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখন সর্বোচ্চে।
এ বিষয়ে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, ‘নানান কারণে মূল্যস্ফীতি কমছে না। বর্তমান সময়টা নানান কারণে কমপ্লেক্স। দীর্ঘসময় ধরে কিন্তু মূল্যস্ফীতি ১০ থেকে ১১ শতাংশে আছে। যদিও রাতারাতি মূল্যস্ফীতি কমানো যায় না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি মুদ্রানীতি সংকোচন করা হয়েছে, তারপরও কমছে না। দেখা যায়, মুদ্রা সরবরাহ কমলে চাহিদা সংকুচিত হয়, তখন দাম কমে আসে। শুধু চাহিদা বৃদ্ধির কারণে নয়, সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটছে বাজার ব্যবস্থায় সিন্ডিকেটের জন্য। বড় বড় জায়গায় বাজার কারসাজি হয়, তারা বড় মুনাফা অর্জন করে। সরকার বাজার মনিটরিং করছে, কিন্তু মূল জায়গায় হাত দিচ্ছে না। পণ্যের সরবরাহ কাজে যারা জড়িত তাদের ধরতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘একটা পণ্যের মূল্য বাড়লে আরো অনেক কিছুর মূল্য বাড়ে। দাম কমাতে আমরা সঠিক কাজ করছি না, এটা সঠিক নীতি নয়। বাজারে একটা সরবরাহ চেইন থাকে, এটা ঠিক করতে হবে। উৎপাদকের কাছ থেকে পণ্য ভোক্তা পর্যন্ত যাওয়ার আগে অনেক পার্টিসিপেন্ট (মধ্যস্বত্বভোগী) থাকে। পণ্যের ক্ষেত্রে পার্টিসিপেন্ট অতিরিক্ত ক্ষমতার অধিকার হলে তারা নিজেদের স্বার্থে মুনাফা অর্জন করবে। এদের সঠিকভাবে ধরতে হবে। সাপ্লাই চেইন বা মূল্য শৃঙ্খলা চেইন থাকে, এটা ঠিকঠাক কাজ করতে হবে। পরীক্ষা করেত হবে কারা অতিরিক্ত ক্ষমতা ব্যবহার করছেন, তাদের ধরতে হবে। সরকার খুচরা ব্যবসায়ীদের হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। অথচ প্রভাব বিস্তারকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এভাবে হবে না। বড় বড় কারসাজি যারা করেন তাদের ধরতে হবে। সঠিক জায়গায় সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে। পুরো বাজারব্যবস্থা একটা প্যাকেজের আওতায় নিতে হবে। সরবরাহব্যবস্থা ও চাহিদাকে একটা সমন্বিত প্রচেষ্টায় নিতে হবে।’