৩১ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা থাকলেও তার আগেই কমিশনের সুপারিশ নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। বিশেষ করে পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি, পদোন্নতিতে কোটা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডার থেকে আলাদা রাখার ক্ষেত্রে যে ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, তা মানতে নারাজ বিসিএস ক্যাডাররা। সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সচিবের বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশের পরপরই বিবৃতি দিয়ে অসন্তোষ জানিয়েছে প্রশাসন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডার সমিতি এবং আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ।
ভিন্ন ভিন্ন দাবি হলেও, সবাই এসব সুপারিশকে ‘বৈষম্যমূলক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রশাসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো বিষয়কে প্রাধান্য না দিয়ে ‘সার্ভিসকেই’ সংস্কারের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
আলোচনার শুরু যেভাবে : গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান। এসময় কমিশনের সম্ভাব্য সুপারিশের কিছু বিষয় তুলে ধরেন তারা।
যেমন পরীক্ষার মাধ্যমে জনপ্রশাসনে উপসচিব পদে নিয়োগ হবে বলে জানান কমিশন প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। বলেন, ‘ডেপুটি সেক্রেটারি লেভেলে পরীক্ষা হবে, সেখানে সবাই পরীক্ষা দিতে পারবে।’ একইসঙ্গে উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে যেখানে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৭৫ শতাংশ ও অন্য ক্যাডারের জন্য ২৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়, তা বদলে এই অনুপাত প্রশাসনের জন্য ৫০ শতাংশ ও অন্য ক্যাডারদের জন্য ৫০ শতাংশ করা হবে বলেও জানান তিনি। এছাড়াও সবক্ষেত্রে পুলিশ ভ্যারিফিকেশন তুলে দেয়া হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
একই সভায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারে না রেখে আলাদা কমিশন করার কথা জানান সংস্কার কমিশনের সদস্য সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান। তিনি বলেন, ‘জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন আলাদা হয়েছে, ঠিক এরকম আমরা স্বাস্থ্য কমিশনকে আলাদা করার এবং শিক্ষা ক্যাডারকে আলাদা কমিশন করার পরামর্শ দিয়েছি।’ ফরিদপুর ও কুমিল্লাকে বিভাগ করার সুপারিশ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
তবে সংস্কার কমিশন প্রধান ও সদস্য সচিবের এসব বক্তব্য ইতিবাচকভাবে নেননি ক্যাডারদের কোনো পক্ষই। গণমাধ্যমে এসব খবর আসার পর থেকেই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান প্রশাসন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডার সমিতি। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতিতে কমিশন প্রধানের বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। একই ঘটনা দেখা যায় বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন এবং বিসিএস হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতিতেও। কোনো রকম আলোচনা ছাড়া এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায় ২৫টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’।
পরীক্ষা দিয়ে পদোন্নতি নিতে সমস্যা কোথায়? কমিশন প্রধানের বক্তব্য নিয়ে অসন্তোষের কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএসএ) সভাপতি ড. মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ বলেন, অন্যান্য ক্যাডার থেকে যে ২৫ শতাংশ দেয়া হয়ে আসছে সেটা ‘হেলদি, একস্পেটেড (গ্রহণযোগ্য)’। কিন্তু এর বেশি হলে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য সেই সুযোগ অত্যন্ত সীমিত হয়ে আসবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
‘কারণ প্রশাসন ক্যাডারে লাইন পোস্টে উপরের দিকে ওঠার মতো কোনো সুনির্দিষ্ট জায়গা নেই।’ বলেন আনোয়ার উল্ল্যাহ। অন্যদেশেও একইভাবে সার্ভিস পরিচালিত হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি শুধু শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন? সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে ইনপুট দিতে হয়। স্পেশালাইজড লোক দিলেই ভালো চলবে এটা বলার সুযোগ নাই।’ কিন্তু পদোন্নতি পেতে পরীক্ষা দেয়ার বিষয়টি মানতে সমস্যা কোথায়? এমন প্রশ্নের জবাবে আনোয়ার উল্ল্যাহ বলেন, পরীক্ষার জন্য যথাযথ মডিউল থাকা প্রয়োজন। পাবলিক সার্ভিস কমিশনে কম্বাইন্ড মেরিট লিস্ট হয়। কম্বাইন্ড মেরিট লিস্টের পর অনেকগুলো প্রশিক্ষণ হয়। সেই মেরিটে একটা পজিশন তৈরি হয়, সেটার একটা নাম্বার থাকা উচিত।’
এছাড়াও কর্মস্থলে কাজের মূল্যায়ন এবং বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নাম্বার দেয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এর পাশাপাশি চাইলে কিছু মার্কের পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। কিন্তু সম্পূর্ণ পরীক্ষার ওপর নির্ভর করে পদন্নোতি হবে এটা সঠিক না।’
আনোয়ার উল্ল্যাহ বলেন, এর আগেও পদোন্নতির ক্ষেত্রে পরীক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল। কিন্তু সেখানেও রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে নেওয়া এবং বাদ দেওয়ার ‘গলদ তৈরি হয়’। ফলে পদোন্নতি যদি সম্পূর্ণ পরীক্ষা নির্ভর হয় তবে সেটা আবারও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হবে এবং সঠিকভাবে মূল্যায়িত হবে না বলেই মনে করেন বিএএসএ সভাপতি।
যা বলছে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ : প্রশাসন ক্যাডার বাদে বাকি ২৫টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত হয়েছে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। বৃহস্পতিবার সংগঠনটি থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ না করেই ডিএস পুলে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ ও অন্য ২৫টি ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ নিয়োগ এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে সিভিল সার্ভিস থেকে আলাদা করার প্রতিবাদ জানানো হয়।
এ নিয়ে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক ড. মফিজুর রহমান বলেন, ‘জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের আটজনের মধ্যে ছয়জনই প্রশাসন ক্যাডার থেকে। বাকি ২৫টি ক্যাডারের কোনো প্রতিনিধিই সেখানে নেই। ফলে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারই গুরুত্ব পেয়েছে।
মফিজুর রহমান আরো বলেন, ‘প্রত্যেক পেশার স্পেশালিস্ট লোক লাগে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন লোকও স্বাস্থ্য ক্যাডারের না। এরকম কৃষি, স্বাস্থ্য বিভিন্ন সেক্টরের সিদ্ধান্ত নেয় অ্যাডমিন ক্যাডাররা। তারা বিভিন্ন সময় নানা মন্ত্রণালয়ে কাজ করে, যার কারণে বাংলাদেশে পেশাদারিত্ব তৈরি হয়নি। একইসঙ্গে নিজ নিজ পেশায় থাকা ক্যাডারদেরই মন্ত্রণালয়ের প্রধান করা এবং উপসচিব হওয়ার ক্ষেত্রেও কোনো কোটাই রাখা যাবে না।’
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডার থেকে বাতিল করার বিষয়ে বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘একটা সার্ভিসকে হুট করে বলে দেওয়া যায় না যে এটা ক্যাডার থাকবে না। এখানে আমরা প্রায় ১৬ হাজার লোক চাকরি করছি। একইসঙ্গে জুডিশিয়াল সার্ভিসের মতো করে নতুন একটি সার্ভিস করার যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, সেটা কী প্রক্রিয়ায় করা হবে সে বিষয় কারও সঙ্গে কোনো আলাপ ছাড়াই কেন এমন সুপারিশ করা হলো, সে প্রশ্নও তোলেন তিনি। অনেকটা একই কথা বলেন বিসিএস হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মোহাম্মদ নেয়ামত হোসেনও। ‘স্বাস্থ্য ক্যাডারে সংস্কার প্রয়োজন সেটা আমরা নিজেরাই বলি। কীভাবে পদোন্নতি দেয়া যায়, কীভাবে বৈষম্য নিরসন করা যায়, কীভাবে রোগীবান্ধব করা যায় এই বিষয়গুলো সংস্কার কমিশনে আসতে পারতো, তার পরিবর্তে স্বাস্থ্য ক্যাডারকে কমিশনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে’ বলেন নেয়ামত হোসেন। ক্যাডারে রেখেই স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার করার কথা বলেন তিনি। সংস্কারের চেয়ে পদায়ন ও পদোন্নতি বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেগুলোর সমালোচনা করছেন বিশ্লেষকরাও। সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, ‘পদোন্নতির জন্য পরীক্ষা, এটাওতো একটা অদ্ভুত ধরনের কাজ।’ একইসঙ্গে চাকরির মধ্যেও কোটাব্যবস্থা রাখাকে ‘বৈষম্য’ বলে মনে করেন তিনি। বলেন, ‘যে সার্ভিসে যিনি পরীক্ষা দেবেন, সেই সার্ভিসে যে পদগুলো সুনির্দিষ্ট আছে- ক্যাডার এন্ড কম্পোজিশন রোলে- সেই পদগুলোতে তাদেরই পদোন্নতি হবে। শিক্ষা ক্যাডার মানেই কি সচিব হতে হবে? আর সে সচিব হতে চাইলে যখন পরীক্ষা হয় তখনতো ওপেন থাকে- কোন ক্যাডার আপনি হবেন। সেখানেতো কোনো বাধা নাই। -বলেন শহীদ খান। ‘এখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব প্রফেসরকে হতে হবে- এই দাবিটা খুবই অযৌক্তিক’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়াও রাষ্ট্রপতির হাতে যে ১০ শতাংশ কোটা আছে, সেটাও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে উল্লেখ করে তা বাতিল করা উচিত বলে মনে করেন সাবেক এই সচিব। অন্যদিকে শিক্ষাবিদ ও শাসন বিশ্লেষক তোফায়েল আহমেদের বলছেন, ‘খরচ কমানো ও কাজের গতিশীলতার স্বার্থে’ অনেক ‘ওভারলাপিং’ বিভাগ বা অধিদফতরকে কমিয়ে আনার সুযোগ আছে। অথচ ‘এখন দেখা যাচ্ছে এসব বড় সংস্কারকে বাদ দিয়ে মানুষের পদায়ন ও পদোন্নতি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোফায়েল আহমেদের মতে, বেশিরভাগ প্রশাসনিক পদ প্রশাসনের আন্ডারে থাকায় তারাই বেশি পদোন্নতি পায়। আর সেখানেই সমস্যা দেখা দেয়। সূত্র : বিবিসি বাংলা