ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর জনপ্রশাসনে বৈষম্য নিরসনে উপসচিব থেকে সচিব পর্যায়ে প্রায় সাড়ে ৪০০র অধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। বিশাল পদোন্নতির পরও ২৫ ক্যাডার হতে সুপিরিয়র সার্ভিসে আগত বঞ্চিত উপসচিবরা আবারো বঞ্চিত।
জানা গেছে, সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরেও প্রশাসন ব্যতীত ২৫ ক্যাডার হতে সুপিরিয়র সার্ভিসে আগত কর্মকর্তারা পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ায় বঞ্চিতদের তালিকা দীর্ঘই রয়েছে। বিভিন্ন সময় নানা পর্যায়ে পদোন্নতি দেয়া হলেও অন্যান্য ক্যাডার হতে আগত পুলভুক্ত কর্মকর্তারা বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে সাবেক আমলারা মনে করছেন, প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ‘বঞ্চিত করার এই রীতি’ প্রশাসনিক কাঠামোকে দুর্বল করবে। এতে বঞ্চিতদের মনোবল ভেঙে যায়। তাদের কাজকর্মে দেখা দেবে অনীহা, বেড়ে যাবে জনপ্রশাসনে অস্থিরতা। পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা, জ্যেষ্ঠতা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেয়া উচিত বলে তারা মনে করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পদোন্নতি বঞ্চিতদের বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কয়েক ধাপে মিটিং হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। এতে ঝুলে আছে প্রশাসনে ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ভাগ্য।
প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সাবেক সচিব আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেছেন, ‘প্রশাসনে বিভিন্ন ক্যাডারের পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধা প্রপ্তির ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের নেতারা লিখিতভাবে কমিশনকে তা জানিয়েছেন। এসব বৈষম্যের মধ্যে যেগুলো আমলযোগ্য, সেসব বিষয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ আকারে পেশ করব।’
সুপিরিয়র সার্ভিস পুলে কর্মরত কয়েকজন উপসচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বছরের পর বছর প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে অন্যান্য ক্যাডারের বৈষম্য চলে আসছে। ক্যাডারের ভিন্নতা থাকলেও চাকরির ১০ বছর পূর্ণ হলে যে কোনো ক্যাডারের কর্মচারী উপসচিব পদে সুপিরিয়র সার্ভিসে পুলভুক্ত হতে পারেন। পুলভুক্তির পর তাদের প্রাথমিক যোগদানকৃত ক্যাডার পরিচিতি থাকে না। সবাই উচ্চতর সার্ভিসের কর্মচারী হিসেবে বিবেচিত হন। সুপিরিয়র সার্ভিসের পরবর্তী উচ্চতর পদগুলো হলো যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব ও সিনিয়র সচিব যা নির্দিষ্ট কোনো ক্যাডার কম্পোজিশনভুক্ত পদ নয়। বিধি অনুসারে পুলের উপসচিব পদে প্রবেশের সময় যে সংখ্যক কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়ে থাকেন তার ৭৫ শতাংশ আসে প্রশাসন ক্যাডার হতে এবং অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ আসে অন্যান্য ২৫ ক্যাডার হতে। বিশেষ কোনো ব্যত্যয় না হলে উচ্চতর সকল পদে এরূপ আনুপাতিক ভারসাম্য থাকা স্বাভাবিক। তবে বাস্তবে তা কখনোই দেখা যায় না এবং বর্তমানে চিত্র অত্যন্ত করুণ। প্রকৌশলী, তথ্য, কাস্টমস, স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ ও শিক্ষাসহ এরূপ ২৫টি ক্যাডার হতে আগত উপসচিবদেরকে পরবর্তী যুগ্ম সচিব বা অতিরিক্ত সচিবের পদোন্নতির সময় জ্যেষ্ঠতার অপব্যাখ্যার ফাঁদে ফেলে বঞ্চিত করা হয় যা বিধিসম্মত নয় ও অনৈতিক। আবার কখনো কখনো বিশেষ মহলের মনগড়া জ্যেষ্ঠতার অপব্যাখ্যা এসএসবি নিজেরাই ভেঙে ফেলার নজির রয়েছে। এ অবস্থায় ২৫ ক্যাডার হতে আগত উপসচিবদের ঊর্ধ্বতন পদে পদোন্নতি দেয়া বা না দেয়া একটি খেলায় পরিণত হয়েছে।
গত এগারো বছরে প্রশাসনে পদোন্নতির ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি মানা হয়নি। ফলে বরাবরের মতোই পদবঞ্চিতদের দীর্ঘ তালিকায় রয়েছেন ২৫ ক্যাডার হতে আগত পুলভুক্ত কর্মকর্তারাও। এবার সেই বঞ্চনা থেকে রেহাই পেতে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৯ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বরাবর আবেদন করেন উক্ত বঞ্চিত কর্মকর্তারা। ওই আবেদনে বলা হয়, বৈষম্যহীন মেধাভিত্তিক জনপ্রশাসন গড়ার লক্ষ্যে ২৫ ক্যাডার হতে আগত বৈষম্যমূলকভাবে পদোন্নতি বঞ্চিত বিসিএস ১৩তম ব্যাচ থেকে ২২তম ব্যাচের উপসচিবদের দ্রুততম সময়ে মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা ও সততার ভিত্তিতে যুগ্মসচিব পদে কনিষ্ঠ কর্মকর্তা দ্বারা অতিক্রান্তের তারিখ হতে ভুতাপেক্ষ পদোন্নতি দেয়া হোক। কারণ আবেদনকারী ১৯৫ জন উপসচিবের প্রত্যেকেই এক বা একাধিকবার কনিষ্ঠ কর্মকর্তা দ্বারা অতিক্রান্ত হয়েছেন। বঞ্চনার ঘটনা ঘটেছে বিগত স্বৈরাচারী সরকার ও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উভয় শাসনকালে।
আবেদনে আরো বলা হয়, প্রশাসনে পদোন্নতির ক্ষেত্রে গত ১৬ বছর ধরে বৈষম্য করা হয়েছে। বর্তমান বৈষম্যবিরোধী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে গত ১৮ আগস্ট এবং ২০ আগস্ট উপসচিব হতে যুগ্মসচিব পদে দুটি পদোন্নতির ক্ষেত্রে একই ধরনের বৈষম্যমূলক নীতি বহাল ও একই কাজের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার হতে আগত ২২তম ব্যাচ পর্যন্ত প্রায় সকল কর্মকর্তাকে যুগ্মসচিব হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। অথচ ২৫ ক্যাডারের ১৩তম ব্যাচ থেকে ২২তম ব্যাচের ১৯৫ জন কর্মকর্তা বঞ্চিত রয়েছেন। পদোন্নতির ব্যাপারে গত এক মাস যাবত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা বিদ্যমান আইন, বিধি এবং চলমান ‘বিশেষ বাস্তবতার আলোকে পদোন্নতি দানে সম্মতি ও অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেও ‘গোয়েন্দা প্রতিবেদনের অজুহাতে পদোন্নতি কার্যক্রম ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। অথচ আগস্ট মাসের ১৩-২৫ মেয়াদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রায় ৪৬৯ জন কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এ বিষয়কে সামনে আনা হয়নি। এ সময়ে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনসমূহে আরোপিত শর্তাদি (যেমন পরবর্তীতে কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো রকম বিরূপ/ভিন্নরূপ তথ্য পাওয়া গেলে তার ক্ষেত্রে এই আদেশের প্রয়োজনীয় সংশোধন/বাতিল করার অধিকার কর্তৃপক্ষ সংরক্ষণ করে) অনুসরণ করা হলে ‘গোয়েন্দা প্রতিবেদন’ পদোন্নতির ক্ষেত্রে বড় কোনো বাধা হতে পারে না। কিন্তু একটির পর একটি নতুন বিষয়কে সামনে আনাকে অন্যান্য ২৫ ক্যাডার হতে পুলভুক্ত উপসচিবদের পদোন্নতিকে বিলম্বিত ও বৈষম্য দীর্ঘায়িত করার অপপ্রয়াস বলে মনে করছেন ২৫ ক্যাডার পুলভুক্ত উপসচিবরা। কৃষি ক্যাডার হতে সুপিরিয়র সার্ভিসে এসেছেন উপসচিব ড. মো. মনসুর আলম। সুপিরিয়র সার্ভিসে এসে একাধিকবার পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন তিনি। পদোন্নতি বৈষম্যের বিষয়ে তিনি আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি জমা দেয়া হয়েছে। স্মারকলিপি জমা দেয়ার পরেও অবস্থার কোনো উন্নতি দৃশ্যমান নয়। আসলে আমাদের স্মারকলিপি প্রধান উপদেষ্টার কাছে আদৌ গ্রহণযোগ্য হয়েছে কি না তার কোনো ফিডব্যাক জানা যায়নি।
তিনি বলেন, বিসিএস ক্যাডার সার্ভিস এবং সুপিরিয়র সার্ভিস দুটোই আলাদা সার্ভিস। অনেকেই জানেন না যে, সার্ভিস দুটো সম্পূর্ণই আলাদা। প্রশাসন ক্যাডার হতে যখন কোনো কর্মকর্তা সুপিরিয়র সার্ভিস পুলে প্রবেশ করেন তখন তাকে কোনো আবেদন করার আবশ্যকতা না থাকায় সার্ভিস দুটির ভিন্নতার বিষয়টি সবার নিকট স্পষ্ট নয়। ক্যাডার কম্পোজিশন ও সুপিরিয়র সার্ভিস সংক্রান্ত যেসব ডকুমেন্টস রয়েছে, তার সবগুলো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে পাওয়া যায় না। মনসুর আলম বলেন, বিসিএস ২৬টি ক্যাডারের যখন কেউ উপসচিব পদে পদোন্নতি পান, তখন তিনি তার পূর্বের ক্যাডার পরিচয় বহন করেন না। কারণ তিনি পদোন্নতি পেয়ে সুপিরিয়র সার্ভিসের সদস্য হয়ে যান। সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব সবাই সুপিরিয়র সার্ভিসের সদস্য। কিন্তু এই নিয়ম বিশেষ ক্যাডারের সবাই ভুলে থাকতে পছন্দ করেন। এভাবে ভূমি দখলের মতোই একটা বিশেষ মহল দ্বারা সুপিরিয়র সার্ভিস জবরদখল হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, ২৫ ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তা মূল ক্যাডার থেকে পুলভুক্ত হলে তার পূর্ববর্তী ক্যাডার পরিচয় থাকে না। সেক্ষেত্রে ২৫ ক্যাডার হতে পুলে আগত কোনো উপসচিব বা তদূর্ধ্বরা বৈষম্যের শিকার হলেও মূল ক্যাডারের কেউ তাদের নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী নন। উপসচিবদেরও মূল ক্যাডারের সদস্যের কাছে গিয়ে কোনো নালিশ করার সুযোগ নেই। শোনা যায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলেন- আমরা কেন প্রশাসনে এসেছি। আবার আমাদের যে মূল ক্যাডার রয়েছে, তারাও বলছেন- আমরা কেন সুপিরিয়র সার্ভিসে গেলাম। দুই দিক থেকেই ২৫ ক্যাডারের উপসচিবরা সমস্যায় রয়েছেন। মূল সত্য হলো ২৫ ক্যাডারের উপসচিবরা কখনো প্রশাসনে যায় না, তারা সেবা দান করে জনপ্রশাসনের সুপিরিয়র সার্ভিসে। বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক Civil Appeal Nos. 294-98 of 2003 -এর প্রদত্ত রায়ে বলা হয়েছে, ‘যখনই কোনো কর্মকর্তা ২০০২ সালের বিধিমালা অনুসারে উপসচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হইলেন, তাহা যে কোনো ক্যাডার হইতেই হউক না কেন, তিনি তখন একজন পরিপূর্ণ উপসচিব। তাহার পূর্বের ক্যাডার পরিচয় তখন বিলুপ্ত হইবে। সচিবালয়ের উচ্চতর উপসচিব পদে তখন তিনি অধিষ্ঠান। সেই অধিষ্ঠা (Status) লইয়াই অন্য সকল উপসচিবের সহিত একশ্রেণিভুক্ত হইয়া সম- অধিকার লইয়া তিনি পরবর্তী উচ্চতর যুগ্মসচিব পদে বা পরবর্তীতে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত হইবার জন্য বিবেচিত হইবেন।’ ২৫ ক্যাডারের ২০তম ব্যাচের উপসচিব মো. সাইফুল ইসলাম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডার হতে আগত ২০তম, ২১তম ও ২২তম ব্যাচের প্রায় সকল কর্মকর্তা উপসচিব থেকে পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব হয়েছেন এবং ১৩তম ব্যাচ থেকে ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা সচিব পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়েছেন। অথচ ২৫ ক্যাডারের ১৩তম ব্যাচ থেকে ২২তম ব্যাচের ১৯৫ জন উপসচিব পদোন্নতির সকল শর্ত পূরণ করেও উপসচিব হতে যুগ্মসচিব পদোন্নতি পাননি। এই বৈষম্য নিরসনে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মরকলিপি দিয়েছি। আশা করছি, কিছু দিনের মধ্যেই অতীতে সৃষ্ট অনৈতিক বৈষম্য নিরসন হবে।’ প্রশাসনে ২৫ ক্যাডারের বঞ্চিতদের বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদ ‘নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুর রউফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।