দেশের ক্রীড়াঙ্গনের নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ছোঁয়াও লেগেছে ২০২৪ সালে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি পদে চেনা মুখ কাজী সালাউদ্দিনের জায়গায় এসেছেন তাবিথ আউয়াল। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল লেস্টার সিটির ফুটবলার হামজা চৌধুরীর বাংলাদেশের জার্সিতে খেলার গেরোও ছুটেছে অবশেষে। মেয়েদের সাফের মুকুট ধরে রাখা : আসরের শেষটা রঙিন হলেও, শুরুটা ছিল না তেমন। পাকিস্তানের বিপক্ষে ‘অপ্রত্যাশিত’ ড্রয়ের ধাক্কার পর বিতর্কের দমকা হাওয়া বয়ে যায় দলের ওপর দিয়ে। কোচ পিটার জেমস বাটলার নাকি পছন্দ করেন না সিনিয়র খেলোয়াড়দের- ‘বোমাটি’ ফাটান মনিকা চাকমা। দুই বছর আগে নেপালে প্রথম সাফ জয়ী বাংলাদেশ দলের এই বিস্ফোরণে মুকুট ধরে রাখার মিশন পড়ে যায় ঘোর অনিশ্চয়তায়। শঙ্কার সেই মেঘ সরে যেতে অবশ্য সময় লাগেনি। পরের ম্যাচেই শক্তিশালী ভারতকে ৩-১ গোলে উড়িয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ, সেমি-ফাইনালে ভুটানকে ৭-১ ব্যবধানে গুঁড়িয়ে ফাইনালের মঞ্চে জায়গা করে নেয় মেয়েরা। এরপর নেপালকে ২-১ গোলে হারিয়ে হয় চ্যাম্পিয়ন! বিতর্কের শুরু যার কথা দিয়ে, সেই মনিকা ফাইনালের মহারণে স্বাগতিক সমর্থকদের স্তব্ধ করে দিয়ে এগিয়ে নেন দলকে, কাঠমা-ুর দশরথ স্টেডিয়ামে নেপালকে সমতার স্বস্তি এনে দিয়েছিলেন আমিশা কারকি। ৮১তম মিনিটে বক্সের বেশ বাইরে থেকে ঋতুপর্ণা চাকমার জোরাল শটে চোখের পলকে বল লুটোপুটি খায় জালে। বাকিটা সময় পার করে টানা দ্বিতীয়বার ট্রফি উঁচিয়ে ধরার বাঁধনহারা উল্লাসে মাতে মেয়েরা। দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েদের ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জয়ের পাশাপাশি টুর্নামেন্টের সেরা গোলকিপার হন রূপনা চাকমা, সেরা খেলোয়াড় ঋতুপর্ণা। মুঠোভরে পাওয়ার আনন্দ নিয়ে দেশে ফিরে আবারও ছাদখোলা বাসে উদযাপনে মাতেন তহুরা-সাবিনা-মনিকারা। দেশের ফুটবলে তো বটেই, ক্রীড়াঙ্গনেও বছরের সেরা সাফল্যের গল্প ছিল এটি। বয়সভিত্তিকের প্রাপ্তি : সিনিয়র দলের অর্জনের আগে বয়সভিত্তিক পর্যায়েও দুটি আনন্দের উপলক্ষ এ বছর পায় বাংলাদেশ। মার্চে নেপালের ললিতপুরে উইমেন’স সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতকে শ্বাসরুদ্ধকর টাইব্রেকারে ৩-২ গোলে হারিয়ে শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। ফাইনালে তিনটি দুর্দান্ত সেভ করে জয়ের নায়ক গোলকিপার ইয়ারজান বেগম, পরে যিনি সিনিয়র সাফ জয়ী দলেও ছিলেন। এই আসরে সুরভি আকন্দ প্রীতি সেরা খেলোয়াড় এবং ইয়ারজান হন সেরা গোলরক্ষক। অগাস্টে বাংলাদেশ পায় সাফ পুরুষ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের স্বাদ। বয়সভিত্তিকের এই ক্যাটাগরিতে এটিই ছিল দলের প্রথম সাফল্য। মিরাজুল-আসিফদের নৈপুণ্যে নেপালকে ফাইনালে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ। ওই আসরে মিরাজুল ইসলাম ৪ গোল করে হন ‘মোস্ট ভ্যালুয়েবল খেলোয়াড়’, মোহাম্মদ আসিফ পান সেরা গোলকিপারের পুরস্কার।
সালাউদ্দিন থেকে তাবিথ : বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ‘চালকের আসনে’ পরিবর্তন আসে ২৬ অক্টোবরের নির্বাচনে। শুরুতে ‘হারি বা জিতি, নির্বাচন করব’ বললেও পরে সেই অবস্থান থেকে সরে আসেন কাজী সালাউদ্দিন। ২০০৮ সাল থেকে দেশের ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থার সভাপতির দায়িত্বে থাকা সালাউদ্দিনের জায়গায় নির্বাচিত হয়ে আসেন সাবেক ফুটবলার, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক তাবিথ আউয়াল। দায়িত্ব নেওয়ার পর এই অল্প সময়ে অবশ্য উল্লেখযোগ্য তেমন ছাপ রাখতে পারেননি তাবিথ। লিগ ও ফেডারেশন কাপের ভেন্যুর মান নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন তিনি। দুই কোচ হাভিয়ের কাবরেরা ও পিটার জেমস বাটলারের ভবিষ্যৎ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও নিতে পারেনি তার কমিটি। তবে তাবিথ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, নতুন বছরে নতুন শুরুর।
লেস্টার সিটির হামজাকে পাওয়া : বছর দেড়েকের প্রচেষ্টায় অবশেষে জট খোলে ১৯ ডিসেম্বর। বাফুফে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইংলিশ ফুটবলার হামজা চৌধুরীর লাল-সবুজের জার্সিতে খেলার ছাড়পত্র ফিফার ফুটবল ট্রাইবুনালের প্লেয়ার স্ট্যাটাস চেম্বার থেকে পাওয়ার বিষয়টি। এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার পর গত অগাস্টের শেষ দিকে তার জন্য এনওসি (নো অবজেশন সার্টিফিকেট) চেয়ে ইংল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে (এফএ) চিঠি দেয় বাফুফে। এফএ-এর কাছ থেকে ছাড়পত্র মেলায় পরের মাসে বৈশ্বিক ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থা ফিফার প্লেয়ার স্ট্যাটাস কমিটির দুয়ারে যায় তারা। সেখান থেকে অনুমতি মেলে বছরের শেষ দিকে এসে। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা হামজা ২০১৫ সালে যোগ দেন লেস্টার সিটিতে। পরের বছর ধারে যোগ দেন বার্টন অ্যালবিয়নে; সেখানে কাটান ২০১৭ পর্যন্ত। গত মৌসুমে ওয়াটফোর্ডে ধারে খেলেছেন ২৬ বছর বয়সী এই ফুটবলার। লেস্টার সিটির সঙ্গে হামজার চুক্তি রয়েছে ২০২৭ সাল পর্যন্ত। লাল-সবুজের জার্সিতে হামজাকে দেখার অপেক্ষা ফুরানোর বিষয়টি এখন স্রেফ সময়ের ব্যাপার। সেটা মিলে যেতে পারে, আগামী মার্চে ভারতের বিপক্ষে এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাইয়ের তৃতীয় রাউন্ডের ম্যাচেই।
ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে দুরবস্থা : হামজাকে পাওয়ার উচ্ছ্বাস থাকলেও তাতে আড়াল হচ্ছে না ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের দুরবস্থা। ১৮৫তম স্থানে থেকে বছর শেষ করছে বাংলাদেশ। এ বছর অফিসিয়াল, আন-অফিসিয়াল মিলিয়ে ১২ ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। ফিফা স্বীকৃত ৮ ম্যাচে জয় মাত্র ২টি, ভুটান ও মালদ্বীপের বিপক্ষে। এই দুই ম্যাচে মাত্র ৩ গোল করতে পারে বাংলাদেশ, বাকি কোনো ম্যাচে পায়নি জালের দেখা। এই আট ম্যাচের মধ্যে ফিলিস্তিন, অস্ট্রেলিয়া, লেবাননের পাশাপাশি ভুটান ও মালদ্বীপের বিপক্ষে হারের তেতো স্বাদও পায় দল। ১৮৩তম স্থানে থেকে ২০২৪ শুরু করেছিল বাংলাদেশ; শেষ করছে দুই ধাপ পিছিয়ে। মেয়েদের র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ নতুন বছরে যাবে ১৩২তম স্থানে থেকে, সাফ জয়ের পর সাত ধাপ উন্নতি হয়েছে মেয়েদের। র্যাঙ্কিংয়ের দিক থেকে প্রাপ্তি বলতে মেয়েদেরটুকুই।
ব্যর্থতায় ভরা প্যারিস অলিম্পিকস : ফুটবলের বাইরে অন্যান্য খেলার মধ্যে জুলাই-অগাস্টের প্যারিস অলিম্পিকসে অ্যাথলেটিকস, সাঁতার, আর্চারি ও শুটিং- এই চার ইভেন্টে অংশ নেয় বাংলাদেশ। স্বপ্ন দেখার মতো কোনো গল্প বরাবরের মতো এবারও নেই। বরং এবার সঙ্গী হয় নানা বিতর্ক! মেয়েদের ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইলের হিটে ৩০ দশমিক ৫২ সেকেন্ড সময় নিয়ে ৭৯ প্রতিযোগীর মধ্যে ৬৪তম হন সোনিয়া খাতুন। গত এশিয়াডে করা সেরা টাইমিং ৩০ দশমিক ১১ সেকেন্ডও পার করতে ব্যর্থ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এই সাঁতারু। সোনিয়ার মতো সামিউল ইসলাম রাফিও ছিটকে যান হিট থেকে। ১০ হিট মিলিয়ে ৭৯ প্রতিযোগীর মধ্যে ৬৯তম হন তিনি। ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে ব্যক্তিগত সেরা টাইমিং (৫৩ দশমিক ১০ সেকেন্ড) করার তৃপ্তি অন্তত সঙ্গী হয় সামিউলের। সরাসরি প্যারিস অলিম্পিকসে খেলার যোগ্যতা অর্জন করা আর্চার মোহাম্মদ সাগর ইসলাম র্যাঙ্কিং রাউন্ড থেকেই ছিলেন সাদামাটা। এলিমিনেশন রাউন্ডের প্রথম ধাপে ইতালির মাউরো নেসপোলির বিপক্ষে ৬-০ সেট পয়েন্টে হেরে বিদায় নেন। একমাত্র শুটার হিসেবে অংশ নেওয়া রবিউল ইসলামের বিদায়ঘণ্টাও বাজে বাছাই থেকে। ৬২৪ দশমিক ২ স্কোর করে ৪৯ প্রতিযোগীর মধ্যে ৪৩তম হন তিনি। দেশের দ্রুততম মানব ইমরানুর রহমান হিটে ১০ দশমিক ৭৩ সেকেন্ড সময় নিয়ে ছিটকে যান। প্রাথমিক পর্বেও ৬টি হিট মিলিয়ে ৪৫ জনের মধ্যে ২৫তম হন তিনি। দৌড় শেষের পরই ‘বোমা’ ফাটান ইমরানুর। দাবি করেন, অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের ‘চাপে’ চোট গোপন করে অংশ নিয়েছেন। এ বিষয়ে অলিম্পিকস কাভার করতে যাওয়া বাংলাদেশের গণমাধ্যমকর্মীরা জানতে চাইলে তাদের ওপর চড়াও হন শেফ দ্য মিশন ও শুটিং ফেডারেশনের সে সময়কার মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপু।
দাবার বোর্ডে মননের কীর্তি, জিয়ার শেষ : এ বছর অক্টোবরে দাবায় দারুণ প্রাপ্তি মনন রেজা নীড়ের। গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদকে ছাড়িয়ে দেশের সবচেয়ে কম বয়সী ইন্টারন্যাশনাল মাস্টারের ‘রেকর্ড’ নিজের করে নেন এই কিশোর। সিক্স ডেইজ বুদাপেস্ট টু ইয়ারস-২০২৪ জিএমণ্ডএ টুর্নামেন্টে অষ্টম রাউন্ডে ভারতের ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার সামবিত পান্দাকে হারিয়ে তৃতীয় নর্ম পান মনন। তাতে অনন্য কীর্তিটি গড়েন তিনি। ১৯৬৬ সালের ১৩ মে জন্ম নেয়া নিয়াজ ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার হন ১৯৮১ সালের ১৩ অক্টোবর। তখন তার বয়স ছিল ১৫ বছর ৫ মাস। ২০১০ সালের ১৮ জুনে জন্ম নেয়া মনন ১৪ বছর ৩ মাস বয়সেই বনে যান ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার। বছরের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনাও ঘটেছে দাবাতে। এনামুল হোসেন রাজীবের বিপক্ষে খেলতে খেলতে হঠাৎ লুটিয়ে পড়েন জিয়াউর রহমান। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলেও ফেরানো যায়নি এই কিংবদন্তিকে। ১৯৭৪ সালের ১ মে জন্ম নেওয়া জিয়ার দাবার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে ছোটবেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃ-বিজ্ঞানে পড়াশোনা করা জিয়া ১৯৮৭ সালে আন্তর্জাতিক রেটিং লাভ করেন। ১৯৯০ সালে ফিদেমাস্টার, ১৯৯৩ সালে আন্তর্জাতিক মাস্টার ও ২০০২ সালে গ্র্যান্ডমাস্টার হন তিনি। প্রিয় দাবার বোর্ডেই জীবনের পথচলা থামে জিয়ার, বিষাদময় দিনটি ছিল ৫ জুলাই।
আর্চারিতে কাণ্ডের ছড়াছড়ি : আর্চারিতে এ বছর ছিল ঘটনার ঘনঘটা। তারকা আর্চার রোমান সানা হঠাৎই মার্চে অবসরের ঘোষণা দিয়ে বসেন। সেসময় ফেডারেশনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের তির ছুঁড়েছিলেন তিনি, পরে অবশ্য অবসর ভেঙে ফেরেন। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে এশিয়া কাপ স্টেজ-১ ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং আর্চারিতে দলগত বিভাগে দুটি রুপা জেতে বাংলাদেশ। ইরাকের বাগদাদে হওয়া প্রতিযোগিতায় রিকার্ভ পুরুষ দলগত বিভাগে ভারতের বিপক্ষে ৬-২ সেট পয়েন্টে হারে আব্দুর রহমান আলিফ, সাগর ও হাকিম আহমেদ রুবেলে গড়া দল। রিকার্ভ মিশ্র দলগত বিভাগের ফাইনালেও সাগর-দিয়া জুটি পাত্তাই পায়নি ভারতের জুটির কাছে।