ত্রিপুরা বসতিতে আগুন

আলোচনায় ‘বেনজীর আহমেদ’

প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে ত্রিপুরাদের ১৭টি বসতি আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আলোচনা চলছে। এতে আলোচনায় উঠে এসেছে ‘এসপি বাগান’ ও বেনজীর আহমেদের নাম। গত মঙ্গলবার রাতে বসতিগুলো আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনার পর আলোচনায় আসে ‘এসপি বাগান’ ও বেনজীর আহমেদ। এ আগুনের ঘটনায় এরইমধ্যে নিন্দা জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এ ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন চারজন। এখন ঘটনার পেছনে ঠিক কী কারণ তা নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন উঠছে। উঠে আসছে জমি দখল এবং চাঁদাবাজির মতো বিষয়। তবে, সব ছাপিয়ে অভিযোগের আঙুল উঠছে কথিত এক এসপি বাগানের দিকে, যার সাথে জড়িয়ে আছে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের নাম। ‘গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার’ অভিযোগে ২০২১ সালে বেনজীর আহমেদসহ র‍্যাবের ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এ ঘটনায় এসপি বাগান এবং বেনজীর আহমেদের নাম কেন আসছে?

সাত-আট মাস আগে সরইয়ের আগুনে ভস্মীভূত টংগঝিরি পাড়াটি স্থাপন করা হয়েছিল। রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে বসবাসরত ত্রিপুরাদের বড় অংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও বান্দরবানের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী সাধারণত খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী বলে জানান স্থানীয় সাংবাদিক সুফল চাকমা। টংগঝিরির নতুন পাড়ায় কোনো গির্জা না থাকায় বড়দিন উদযাপনে একই এলাকার পুরনো পাড়ায় যান বাসিন্দারা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঘরগুলোতে আগুন দেয়া হয়। বাসিন্দাদের অনেকের সন্দেহ-এর পেছনে রয়েছে চাঁদাবাজিকেন্দ্রিক পূর্ব শত্রুতা। মার্জেল ত্রিপুরা নামে একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘কয়েকজন ব্যক্তি তাদের কাছে চাঁদা দাবি করেছিল কিছু দিন আগে। এদের নামে স্থানীয় থানায় অভিযোগও জানান।’

এখন সেই ব্যক্তিদের সন্দেহ করছেন তারা। ‘এর আগে হুমকি দিছে টাকা না পেলে ঘর পুড়ে দেবে’ এমনটা জানিয়ে পাড়ার আরেক বাসিন্দা অরাতি ত্রিপুরার মন্তব্য, ‘যদি থাকতাম তাহলে আমরাও মরে যেতাম।’ পাড়া প্রধান পাইসাপ্রু ত্রিপুরা অভিযোগ করেছেন, ‘কয়েকজন পাহাড়ি ও বাঙালি একজোট হয়ে এর আগে অস্ত্র নিয়ে চাঁদাবাজি করতে এসেছিল। তারাই পাড়ার ১৯টি ঘরের মধ্যে ১৭টি জ্বালিয়ে দিয়েছে।’ ধর্মীয় উৎসবের আগে আগে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের ঘর পোড়ানোর এ ঘটনায় চাঞ্চল্য তৈরি হয়।

এদিকে, বান্দরবানের লামার আগুনের ঘটনায় উঠে আসছে ‘এসপি বাগান’ নামে একটি ফলের বাগানের নাম। এ বাগানের জমি দখলকে কেন্দ্র করেই আগুনের ঘটনা ঘটেছে বলে সন্দেহ করছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ। সরই ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মো: জামাল উদ্দিন জানান, স্থানীয়ভাবে কথিত আছে, বাংলাদেশের সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের নাম করে কয়েক বছর আগে ওই বাগানটি গড়ে তোলা হয়। এমন প্রশ্নের উত্তরেও তিনি টেনে আনলেন বেনজীর আহমেদের নাম।

বান্দরবানে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের সম্পত্তি আছে গত বছর এমন খবর প্রকাশের পর তৎকালীন উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশে এসপি বাগানে খোঁজখবর নিতে যান জামাল উদ্দিন। জামাল উদ্দিন বলেন, ‘দেখভালের দায়িত্বে থাকা ইব্রাহিম, এটি বেনজীর আহমেদের সম্পত্তি কী না সে ব্যাপারে কিছু জানেন না। তবে, কোনো এক জেলার এসপি তাকে নিয়োগ দিয়েছেন বলে জানান।’ তাই সেটি এসপি বাগান নামেই পরিচিতি পায়। আগুনের ঘটনায় যে মামলা হয়েছে তাতে তালিকাভুক্ত আসামি হিসেবে আরো তিনজনের সাথে ইব্রাহিমকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ছোটবেলা থেকেই টংগঝিরি এলাকার শেষ প্রান্তের ওই জমিতে ত্রিপুরাদেরই বসবাস করে আসতে দেখছেন স্থানীয় ইউপি মেম্বার জামাল উদ্দিন। ‘১০ থেকে ১২ বছর আগে সেখানে বাগানটি গড়ে ওঠে। মূলত আমগাছ লাগানো হয়েছিল, বলেন তিনি। নানাভাবে এর সাথে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের নাম শোনা গেলেও এ অভিযোগ বিবিসি নিরপেক্ষভাবে যাচাই করতে পারেনি। তবে, স্থানীয়ভাবে এটি বেনজীর আহমেদের বাগান বলে প্রচারণা ছিল। যে কারণে গত বছর ইউপি মেম্বার জামাল উদ্দিনকে ঘটনার সত্যতা খুঁজতে যেতে হয়েছিল।

তিনি কেয়ারটেকারের কাছ থেকে বেনজীরের সম্পৃক্ততা আদৌ আছে কি না, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য পাননি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা রুপায়ন দেব বলেন, এসপি বাগানের ওই জমিটি মূলত সরকারি খাসজমি। তিনি বলেন, ‘সরকারি খাস জমিতে ত্রিপুরারা চাষবাস করতেন। পরে ১০ বছর ধরে এসপি বাগান নামে জায়গাগুলো দখল করে রাখছিল। কিন্তু, কাগজপত্র নাই। স্টিল এগুলো খাস জমি।’ তিনি আরো বলেন, ‘সাত-আট মাস আগে বেনজীর আহমেদকে নিয়ে যখন খবরাখবর ছড়াতে থাকে, তখন ওই কেয়ারটেকার এসপি বাগান ছেড়ে চলে যান। সেই সুযোগে ত্রিপুরা পরিবারগুলো জমির দখল নেয়ার পাল্টা চেষ্টা চালায় এবং ঘর তোলে।’ এ কর্মকর্তা জানান, তাদের ভিন্ন জায়গায় বাড়ি আছে। সেসব বাড়ি দেখে এসেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মূলত দখলের জন্যই নতুন ঘরগুলো তোলা হয়েছিল।’

বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বেনজীর আহমেদ বা তার পরিবারের সম্পত্তি পাওয়া গেলেও লামা উপজেলায় তাদের নামে কোনো জমি নেই বলে নিশ্চিত করেছেন ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুপায়ন দেব। প্রসঙ্গত, দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে গত ১২ জুন আদালতের পক্ষ থেকে নির্দেশ জারি করা হয়। তার মধ্যে বান্দরবানের সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নে ২৫ একর জমি ছিল। আদালতের নির্দেশের পর ওই চৌঠা জুলাই ওই সম্পত্তি নিজেদের তত্ত্বাবধানে নেয় জেলা প্রশাসন। স্থানীয় বাসিন্দাদের সন্দেহের তালিকায় ঘুরে ফিরেই এসপি বাগানের সাথে সম্পৃক্ত দু’জন বাঙালি ও পাঁচ-ছয়জন ত্রিপুরার নাম উঠে আসছে।