জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ে রাজনৈতিক অতিকথন ও বন্দনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। গত সরকারের চালু করা সৃজনশীল শিক্ষাক্রম বাদ দিয়ে শিক্ষায় চালু করা হয়েছে ২০১২ সালের কারিকুলাম। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণীত নতুন শিক্ষাবছরের পাঠ্যবই গত ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, বিভিন্ন শ্রেণির পরিবর্তিত পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়েছে ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের নানান গল্প, ছবি, কার্টুন, গ্রাফিতিসহ বিভিন্ন বিষয়। পাঠ্যবই থেকে বাদ দেয়া হয়েছে অতিরিক্ত শেখ মুজিববন্দনা। চার নেতার বিবরণীতে স্থান পেয়েছেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার ঘোষণায় স্থান পেয়েছেন মেজর জিয়াউর রহমান।
জুলাই আন্দোলনে রাজধানীর বাড্ডায় হেলিকপ্টার থেকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করার বিষয়টি পাঠ্যবইয়ে কার্টুনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। জুলাই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী শহীদ হওয়া আবু সাঈদ ও মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের নাম যুক্ত করা হয়েছে। নতুন পাঠ্যবইয়ে জনআন্দোলনে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের গণভবন ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও উঠে এসেছে। এনসিটিবির তথ্য মতে, ষষ্ঠ শ্রেণির চারুপাঠে ‘কার্টুন, ব্যঙ্গচিত্র ও পোস্টারের ভাষা’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপানো হয়েছে। কার্টুনের ছবির মাধ্যমে যে প্রতিবাদ বা বিদ্রোহের প্রকাশ ঘটে, তা দেখানো হয়েছে এই লেখায়। এখানে বলা হয়েছে, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত বারবার কার্টুনে প্রতিবাদের প্রকাশ দেখা গেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সারা দেশের দেয়ালে দেয়ালে অসংখ্য গ্রাফিতির কথাও বলা হয় এই লেখায়। এই লেখায় কার্টুনের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়ার চিত্র। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ে যুক্ত করা হয়েছে ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ অধ্যায়টি। দেশের জন্য যুদ্ধ করে শহীদ মীর নিসার আলী তিতুমীর, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, শহীদ মতিয়ুর রহমান মল্লিক, সার্জেন্ট জহুরুল হক, ড. মুহম্মদ শামসুজ্জোহা, নূর হোসেনসহ বিভিন্ন শহীদের তথ্য তুলে ধরা হয়। এই অধ্যায়ের সংযোজন করা হয় জুলাই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থী শহীদ হওয়া আবু সাঈদ ও মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের নাম। এই অধ্যায়ে বলা হয়েছে, অধিকারের দাবি ও বৈষম্যের কথা বলতে গিয়ে ২০২৪ সালে রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। সরকারি বাহিনী নির্মমভাবে সেই আন্দোলন দমন করতে চায়।
পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রংপুরে ছাত্রনেতা আবু সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ান। পুলিশ তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে। এতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সারা দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, বিশাল গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়। আরও বলা হয়, রাজধানীর উত্তরায় শিক্ষার্থী মুগ্ধ আন্দোলনরত সবাইকে পানি বিতরণ করতে করতে নিহত হন। নবম ও দশম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ২৬ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর তিনি ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আবারও স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা সাহিত্য বইয়ে স্থান দেয়া হয়েছে ‘আমাদের নতুন গৌরবগাঁথা’ অধ্যায়। এ অধ্যায়ে গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের গণভবন ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে।
এখানে বলা হয়, সেদিন ৫ আগস্ট ২০২৪ ইং ৩৬ জুলাই। বাংলাদেশের ক্যালেন্ডার জুলাইতে থেমে গেছে। শুধু দেশ নয়, সারা দুনিয়ার মানুষ তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের দিকে। আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা এক দফা দাবি পেশ করেছে। সারা দেশ থেকে মানুষ ঢাকায় ছুটছে। ঘেরাও করবে গণভবন। মূলোৎপাটন করবে শাসনক্ষমতা আঁকড়ে থাকা ফ্যাসিবাদী শাসককে। কারফিউ উপেক্ষা করে ঢাকার উত্তরার পথে মানুষের দেখা মিলল। যাত্রাবাড়ীর দিকে মানুষ জড়ো হতে থাকল ধীরে ধীরে। নামল মানুষের ঢল। জনতা গণভবনে পৌঁছে যায় দুপুর নাগাদ। পতন অত্যাসন্ন টের পেয়ে স্বৈরাচার সরকারপ্রধান পালিয়ে যান দেশ ছেড়ে। এ অধ্যায় আরও বলা হয়, ২০২৪ সালের শুরুতে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সরকার। উঠে আসে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অবদানের কথাও। এ অধ্যায়ে বলা হয়, সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পর আন্দোলন কর্মসূচি গতি হারাতে পারত। কিন্তু বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা তখন ব্যাপকভাবে এগিয়ে আসেন। এই পাঠ্য বইয়ে আওয়ামী আমলের দীর্ঘ দুঃশাসনের কথাও উঠে আসে। সামান্য দাবির কারণে নির্বিচারের নির্যাতন আর গুম-খুন করা হয়েছে- বলে পাঠ্যবইয়ে উল্লেখ করা হয়। এ অধ্যায়ে বছরের পর বছর ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুট হওয়াও উঠে আসে।