টানা পাঁচ বছরের স্থবিরতার পর অবশেষে আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন আয়োজনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই শিক্ষার্থীরা এ দাবি জানিয়ে আসছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ অথবা ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে প্রশাসন। এরইমধ্যে একটি কমিটিও গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নির্বাচনের বিষয়ে প্রশাসন ইতিবাচক হলেও বিতর্ক বেঁধেছে ডাকসু নির্বাচনের ‘রোডম্যাপ’ ঘোষণা নিয়ে। শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল সব ছাত্র সংগঠন একমত হলেও রোডম্যাপ ও গঠনতন্ত্র সংস্কার নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংসদ ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠন দ্রুততম সময়ের মধ্যেই ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য তারা সময় বেঁধে দিয়ে দুই দফায় আল্টিমেটামও দিয়েছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি অংশও। আর ছাত্রদল, ছাত্র ফেডারেশনসহ অন্য কয়েকটি ছাত্রসংগঠন বলছে, নির্বাচন দিতে হবে। তবে তার আগে ডাকসুর বর্তমান ‘অগণতান্ত্রিক’ গঠনতন্ত্র সংস্কার করে তারপর নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে গত ১ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানকে স্মারকলিপি জমা দেয় স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংসদ, ছাত্রশিবিরসহ চারটি ছাত্র সংগঠন। সেদিন তারা এই দাবি বাস্তবায়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ‘দুই কার্যদিবস’ সময়ও বেঁধে দেন। পরের দিন সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা চলাকালে বাইরে একই দাবিতে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ ব্যানারে শিক্ষার্থীদের একটি দল স্লোগান দিতে থাকে।
২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের সামনে শুরুতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা এবং পরে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা জড়ো হন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা সিন্ডিকেটে আওয়ামীপন্থিদের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে এবং দ্রুত ডাকসু নিশ্চিতের দাবিতে স্লোগান দেয়। এসময় ছাত্রদলের নেতাকর্মীরাও সিন্ডিকেটে আওয়ামীপন্থিদের রাখা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে সিনেটের সামনে আসেন। ডাকসু নিয়ে সিন্ডিকেটে যেন কোনো আলোচনা না হয়, সে বিষয়ে ছাত্রদলের কয়েকজন নেতাকর্মী উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানের সঙ্গে ‘বাকবিতন্ডায়’ জড়িয়ে পড়েন। যদিও এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের পক্ষ থেকে জড়িতদের শোকজ করে ঢাবি ছাত্রদল।
ছাত্রদল নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে এখনই ডাকসু না দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। ছাত্রদলের দাবি, তারাও নির্বাচন চান, তবে তাড়াহুড়ো করে নয়। নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার আগে কিছু সংস্কারের কথা জানায় সংগঠনটি।
দলটির বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ডাকসু সংস্কার ও নির্বাচনের বিষয়ে আমরা এরইমধ্যে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। এক্ষেত্রে কোনো আল্টিমেটাম বেঁধে দিয়ে তাড়াহুড়ো করার পক্ষে আমরা নই, বরং যৌক্তিক সময় নিয়ে সকল স্টেকহোল্ডারের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে ডাকসুর গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু সংস্কারের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে যাচ্ছি।
গণেশ বলেন, গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ছাত্রদল আবারো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মুক্তভাবে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে। নতুন এ বাংলাদেশে তারেক রহমানের সাম্য ও মানবিক বাংলাদেশের ভিশনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ডাকসুর গঠনতন্ত্রসহ ছাত্রলীগের ফ্যাসিবাদী থাবা যেসব জায়গায় পড়েছে তা সমূলে উৎপাটিত করে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক সেন্টিমেন্টকে ধারণ করেই রাজনীতি করতে চায়। আর সেই রাজনীতিতে ডাকসু হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণতন্ত্র চর্চার সর্বোত্তম প্লাটফর্মণ্ড এটাই আমাদের চাওয়া।
খুব দ্রুত ডাকসু গঠনতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে সংস্কার প্রস্তাব দিবে ছাত্রদল উল্লেখ করে গণেশ বলেন, ডাকসুর গঠনতন্ত্র ও নির্বাচনপদ্ধতি সংস্কারের বিষয়ে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের সুনির্দিষ্ট সংস্কার প্রস্তাব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অচিরেই জানাবো এবং সেই সাথে আপনাদেরকেও অবহিত করবো। তারপর আমরা এই সব সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের অবহিত ও সচেতন করতে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করবো।
তবে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে অথবা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন চায় শিবির। সংগঠনটির দাবি, অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন দেয়ার। ঢাবি শিবির সভাপতি এসএম ফরহাদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন করার যে কথা জানিয়েছে, আমরা মনে করি এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যে সংস্কার সেগুলো জানুয়ারির মধ্যেই করে ফেলা হোক।
ফরহাদ বলেন, ডাকসু শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি। যেখানে শিক্ষার্থীরা ডাকসু দ্রুত চায় সেখানে দিতে দেরি করা হবে কেন? খুব দ্রুত শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ হোক; শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে যে ভীতি তা ডাকসুর মাধ্যমে দূর হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
এদিকে ডাকসুর বর্তমান গঠনতন্ত্র ‘অগণতান্ত্রিক’ দাবি করে সেটি সংস্কারের পর দ্রুত নির্বাচন দেয়ার কথা বলছে বাম ঘরানার ছাত্র সংগঠনগুলো। একই সঙ্গে যারা ‘এখনই নির্বাচন’ চাইছেন, উত্তেজিত না হয়ে তাদের ‘সংস্কার সাপেক্ষে দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের’ কথা বলার আহ্বান জানিয়েছেন ছাত্র নেতাদের কেউ কেউ।
গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের আহ্বায়ক সালমান সিদ্দিকী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা চাই, অবিলম্বে ডাকসু নির্বাচন করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে ডাকসু বন্ধ থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছিল। ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতনের পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে গণতান্ত্রিক ভিতের ওপর দাঁড় করানোর আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়েছে। এর অংশ হিসেবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবিলম্বে ডাকসু নির্বাচন দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, তবে নির্বাচনের আগে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। যাতে সব সংগঠন সমানভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারে। নির্বাচনের আগে ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ডাকসু’র গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে হবে এবং অগণতান্ত্রিক ধারাগুলো বাতিল করতে হবে। এবারের ডাকসু নির্বাচন যেন ২০১৯ সালের মত প্রহসনমূলক না হয়ে সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়- সেদিকে প্রশাসনকে নজর দিতে হবে।
বর্তমানে ডাকসুর গঠনতান্ত্রিক যে কাঠামো, সেটিকে ‘মোটেই গণতান্ত্রিক নয়’ বলে উল্লেখ করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘এই কাঠামোর মধ্যে নির্বাচন হলে প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র মাথাচাড়া দেবে। তাই গঠনতন্ত্রের সংস্কার হওয়া জরুরি। সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে কার্যকর আলাপ-আলোচনা শুরু করা দরকার। তারপর আসবে ডাকসুর রোডম্যাপ ঘোষণার কথা।’
মোজাম্মেল বলেন, কত দ্রুত বা কত দেরিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে; তা নির্ভর করবে প্রশাসনের এসব প্রয়োজনীয় উদ্যোগ কেমন গতিতে চলবে, তার ওপর। ডাকসুর গঠনতান্ত্রিক সংস্কার সম্পন্ন করে অবিলম্বে ডাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ দেয়া হোক, এটা আমরা চাই।
ছাত্র ফেডারেশন ঢাবি শাখার আহ্বায়ক আরমানুল হক বলেন, ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে বহুবছর ধরে চলে আন্দোলনে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, ফলে ২০১৮ সালে প্রশাসন ঘোষণা করে ২০১৯-এর মার্চে নির্বাচনের আয়োজন করবে। আমরা ডাকসু গঠনতন্ত্রের গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য প্রশাসনকে প্রস্তাব দিয়ে আসছি। সেই জায়গা থেকে ডাকসু নির্বাচন অতিদ্রুত আয়োজন করা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করা জরুরি।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ডাকসুর গঠনতন্ত্রে কি কি পরিবর্তন, সংযোজন কিংবা বিয়োজন করা দরকার সেলক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘গঠনতন্ত্র সংস্কার কমিটি’ গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এরইমধ্যে এই কমিটি একটি সভাও করেছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) সায়মা হক বিদিশা আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, এরইমধ্যে গঠনতন্ত্র সংস্কার কমিটি একটি মিটিং করেছে। বিভিন্ন অংশীজনের সাথে কথা বলছেন। ডাকসুর নির্বাচন নিয়ে গত বৃহস্পতিবার সিন্ডিকেট সভার শুরু ও শেষে ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে উপাচার্যের কথাও হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত কী, সেটি ডাকসু নিয়ে গঠিত কমিটির পরামর্শ ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে জানানো হবে।