ঢাকা ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২৪ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

টেকনাফের পাহাড় ঘিরে আতঙ্ক ‘অপহরণ’

স্থানীয়দের দাবি সেনা অভিযান
টেকনাফের পাহাড় ঘিরে আতঙ্ক ‘অপহরণ’

কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ। এখানকার সবুজ পাহাড়গুলো যেনো অপহরণ ও মুক্তিপণ-বাণিজ্যের অভয়ারণ্য। স্থানীয় বাসিন্দা, রোহিঙ্গা নাগরিক, এমনকি ভ্রমণে আসা পর্যটক- কেউই রেহাই পাচ্ছে না অপহরণ চক্রের কবল থেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য বলছে, গত এক বছরে ১৯২ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন অভিযানে অনেকে উদ্ধার হলেও, আবার অনেকে ফিরেছেন মুক্তিপণ দিয়ে। কোনো অপহৃত ব্যক্তির মৃতদেহ মিলেছে পাহাড়ে। এমন প্রেক্ষাপটে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে সেনা অভিযান চালানোর দাবি করছেন স্থানীয় বাসিন্দাসহ সচেতন নাগরিকরা। গতকাল রোববার সকালে কক্সবাজার শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালনের পর জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। বিভিন্ন তথ্য বলছে, দুর্গম পাহাড় ঘিরে কয়েকটি স্বশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে। যাদের সংখ্যা ৩-৪শ’র মতো। যারা পাহাড়ে পাহাড়ে তৈরি করেছে বিশেষ আস্তানা। কিছু সংখ্যক স্থানীয়দের আশ্রয় প্রশ্রয়ে চলছে এমন অপরাধ। বিগত সরকারের সময় এই চক্রটিকে কতিপয় প্রভাবশালীর সখ্যের অভিযোগ ছিল। কিন্তু ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে এসেও তা বন্ধ না হওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে বহুগুণ। গত এক সপ্তাহে অপহরণ হয়েছে ৩০ জন। যার মধ্যে দুইজন এখনও জিম্মি রয়েছে। টেকনাফের মানুষ মনে করেন, সেনা বাহিনীর নেতৃত্বে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হলে এই ভয়াবহ অপরাধ রোধ করা সম্ভব। স্থানীয় সূত্র বলছে, টেকনাফের বাহারছড়া, জাহাজপুরা, লেদা, মুছনি, হ্নীলা, রইক্ষ্যং, জাদিমুড়া ও হোয়াইক্যংয়ে বেশি অপহরণের ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে বেশি বাহারছড়ার নোয়াখালীপাড়া, বড় ডেইল, মাথাভাঙা, জাহাজপুড়া, ভাগগুনা, মারিশবনিয়া, হোয়াই্যকংয়ের ঢালা, চৌকিদারপাড়া, দক্ষিণ শীলখালী গ্রামের মানুষ বেশি অপহরণ ভয়ের মধ্য আছেন। মূলত পাহাড়ি এলাকাগুলোয় বেশ কয়েকটি অপহরণ চক্র সক্রিয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আর্থিকভাবে সচ্ছল বা প্রবাসে আত্মীয়-স্বজন রয়েছে- এমন পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। গত ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর টেকনাফে অপহৃত হন জাদিমুরায় এক বনকর্মীসহ বন বিভাগের অধীনে কর্মরত ১৯ জন শ্রমিক, এক দোকানদার ও চালকসহ ৮ যাত্রী। এরমধ্যে র‌্যাবের অভিযানে ১৮ জন। আবার অনেকে ফিরেছেন মুক্তিপণ দিয়ে। খোজঁ নিয়ে জানা গেছে, মিয়ানমারের কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে স্থানীয় কিছু ডাকাত মিলে অপরহণ করে মুক্তিপণ আদায়ই তাদের প্রধান টার্গেট। এসব ঘটনার রহস্য উদঘাটনে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের এক সদস্য বলেন, ‘অপহরণের ভয়ে এলাকার লোকজন সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হন না। গত পাঁচ মাসে আমার এলাকায় অর্ধশতাধিক অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন বেশির ভাগ।’

হত্যার ভয়ে অপহরণের শিকার লোকজন থানায় যেতে চান না উল্লেখ করে এই ইউপি সদস্য বলেন, ‘অপহরণের পর তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে উদ্ধার করা হয়েছে, এমন নজির নেই। পুলিশকে জানালে নির্যাতন করে হত্যার হুমকি দেয় অপহরণকারীরা। অপহরণ বাণিজ্যে ১০-১২ গ্রুপের শতাধিক ব্যক্তি জড়িত।’

একাধিক সূত্রের তথ্য বলছে, অপহরণ ও মানব পাচার বাণিজ্যে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ লম্বরী এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ও তার বোনের স্বামী ইসমাইল, মোরশেদ বাহিনীর মোরশেদ, মো. রিদুুয়ান, ফয়সাল, ইয়াছিন, গফুর, নুর নবী মাঝি, তোফায়েল আহমেদ, মাঠপাড়ার কামাল, মো. ফারুক, নতুন পল্লান পাড়ার আবদুল্লাহ, সাবরাং কচুবনিয়ার মো. আব্দুল্লাহ, মহেষখালিয়া পাড়ার ইয়াছিন, দক্ষিণ নেঙ্গুল বিলের গফুর, আজিমুল্লাহ, ফেরদৌস আক্তার, মো. ইউনুছ, মো. রফিক, সাইফুল্লাহ, উত্তর লম্বরীর মো. আইয়ুব, হ্নীলা পানখালীর আনোয়ার, বাহারছড়া ইউনিয়ন নোয়াখালী পাড়ার ছৈয়দুল হক প্রকাশ লেংগা, আব্দুল আলী, সাইফুল, আব্দুল আলী, ছৈয়দুল হক ও কেফায়েত উল্লাহ জড়িত।

পাহাড়ি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় উপজেলার হ্নীলা ও বাহারছাড়া ইউনিয়নে অপহরণের ঘটনা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার জনপ্রতিনিধিরা। তাদের ভাষ্যমতে, গত বছরের তুলনায় এ বছর অপহরণের ঘটনা বেশি। হ্নীলা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নুরুল হুদা বলেন, ‘সবার মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কে কখন অপহরণের শিকার হয়, তা নিয়ে ভয় সবার। এসব ঘটনার পেছনে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে।’

বাহারছড়ার ইউপি সদস্য হুমায়ুন কবির বলেন, ‘যতক্ষণ স্থানীয় মানুষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং জনপ্রতিনিধিরা যৌথভাবে কাজ না করবেন, ততদিন এ অপরাধ রোধ অসম্ভব।’ এ বিষয়ে টেকনাফ মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঝিমিয়ে পড়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘প্রযুক্তির সহায়তায় অপহৃতদের অবস্থান জানার চেষ্টা করে পুলিশ। অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে উদ্ধারসহ আটক করা হয় কয়েকজন অপহরণকারীকে। আগের তুলনায় এখন অপহৃত পরিবারের সদস্যরা বেশি থানায় আসছেন। আমরাও অপহরণকারীদের ধরতে তৎপরতা বাড়িয়েছি।’ কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচএম সাজ্জাদ হোসেন জানান, দুুর্গম পাহাড়ে র‌্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়ছে জানিয়ে বলেন, বেশ কয়েকটি অভিযানে অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর দীর্ঘ অভিযানে বনে অপহৃত ১৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। মূলত ড্রোন অভিযানের ফলে অপহরণকারীরা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে যায়। এর কারণে আমরা অপহৃতদের উদ্ধারে সক্ষম হয়েছি।

অপহরণ বন্ধে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে বিশেষ অভিযানের দাবি : এদিকে টেকনাফের পাহাড়ে সেনা বাহিনীর নেতৃত্বে বিশেষ অভিযানের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি ও স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। টেকনাফের সন্তান কবি ও সাংবাদিক নুপা আলমের ব্যক্তিগত উদ্যোগে গতকাল রোববার বেলা ১১টায় কক্সবাজার কেন্দ্রীয় কর্মসূচি শুরু হয় অবস্থান কর্মসূচির। যেখানে বিভিন্ন পেশাজীবী, রাজনীতিবিদসহ অনেকেই সংহতি জানিয়ে তার পাশে অবস্থান নেন। অবস্থান কর্মসূচিতে সূচনা বক্তব্যে নুপা আলম বলেন, গত কয়েক বছর ধরে টেকনাফের পাহাড়কেন্দ্রিক রোহিঙ্গা ও স্থানীয় কতিপয় অপরাধের নেতৃত্বে স্বশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পাহাড়ে অবস্থান নিয়েছে। যারা কয়েক বছরে ধরে ধারাবাহিকভাবে সাধারণ স্থানীয় মানুষ ও রোহিঙ্গাদের অপহরণ করে পাহাড়ে জিম্মি করে আসছে। ওখানে নিমর্ম নির্যাতন -পরবর্তী মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা ও হত্যা ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত