মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের বিষয়টি পাঠ্যবইয়ে সবসময় ‘মীমাংসিত সত্য’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়ে আসছে। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি- সব দলের শাসনামলে এটি প্রায় একইভাবে বর্ণনা করা হয়েছিল। এবার কয়েকটি বইয়ে সেই ইতিহাস বর্ণনার ধারায় ভিন্নচিত্র দেখা গেছে। মাধ্যমিকের সপ্তম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা জানাতে ‘লাখো’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়া মাধ্যমিকের ষষ্ঠ, নবম-দশম ও প্রাথমিকের তৃতীয় শ্রেণির বইয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের নতুন যে সংস্করণ ছাপিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়া হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের এর আগের সংস্করণে (২০১৫-২০২১) একই জায়গায় ‘৩০ লাখ’ উল্লেখ করা হয়েছিল। এরপর নতুন শিক্ষাক্রমে ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইটি বাদ দিয়ে ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ নামে বিষয় যুক্ত করা হয়। তাতেও শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ উল্লেখ ছিল। পাঠ্যবইয়ের এমন বর্ণনায় সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ‘আগুনে ঘি ঢালার মতো’ অবস্থা হতে পারে বলে মনে করছেন ইতিহাস ও শিক্ষাবিদরা। যদিও বিষয়টি বড় কোনো ইস্যু নয় বলে দাবি করেছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা।
সপ্তম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইটি প্রথম প্রকাশ করা হয় ২০১১ সালের অক্টোবরে। অর্থাৎ, ২০১২ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীরা বইটি প্রথম হাতে পেয়েছিল। ২০১৪ সালে প্রথমবার পরিমার্জন করা হয়। ২০১৭ সালে দ্বিতীয়বার এবং ২০২০ সালে তৃতীয়বার পরিমার্জন হয় বইটি। এরপর ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে বইটি বাদ দেওয়া হয়। ২০২০ সালের পরিমার্জন করা বইটি ২০২২ শিক্ষাবর্ষে সবশেষ পড়েছে শিক্ষার্থীরা। সেখানে প্রথম অধ্যায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের আগের পরিস্থিত, মুক্তিযুদ্ধ শুরু এবং বিভিন্ন ঘটনার পর শেষের দিকে বলা হয়েছে, ‘...শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের ২৪ বছরের শোষণ আর বৈষম্যের অবসান ঘটায় বাঙালি। ফলে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।’
চলতি শিক্ষাবর্ষ অর্থাৎ ২০২৫ সালের ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম’। এ অধ্যায়ে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। শেষ দিকে উল্লেখ রয়েছে, ‘... শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জনযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের ২৪ বছরের শোষণ ও বৈষম্যের অবসান ঘটে। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
তৃতীয় শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, ‘প্রায় নয় মাস ধরে মুক্তিযুদ্ধ চলে। পাকিস্তানি বাহিনী অবশেষে হার মানতে বাধ্য হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারা আত্মসমর্পণ করে। আমরা বিজয় অর্জন করি।’ একইভাবে ষষ্ঠ এবং নবম-দশম শ্রেণির একই বিষয়ের বইয়েও সুনির্দিষ্টভাবে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা উল্লেখ নেই।
চতুর্থ-পঞ্চমণ্ডঅষ্টমের বই ৩০ লাখ উল্লেখ : প্রাথমিকের চতুর্থ ও পঞ্চম এবং মাধ্যমিকের অষ্টম শ্রেণির বইয়ে মুক্তিযুদ্ধ অধ্যায়ের লেখায় ৩০ লাখ শহীদের কথা উল্লেখ রয়েছে। চতুর্থ শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে মুক্তিযুদ্ধ অধ্যায়ে উল্লেখ রয়েছে, ‘..১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ চলে। এ যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হন, অসংখ্য মানুষ পঙ্গু হন, অনেকেই ঘরবাড়ি হারান...।’
পঞ্চম শ্রেণির বইয়ে ২৫ মার্চের গণহত্যা নিয়ে লেখা একটি অনুচ্ছেদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। তাছাড়া অষ্টম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়েও ৩০ লাখ শহীদের কথা উল্লেখ রয়েছে।
লেখক ও গবেষক এস এম নাদিম মাহমুদ পাঠ্যবইয়ে শহীদের সংখ্যা এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ পোস্ট দিয়েছেন। তার শেষাংশে তিনি লিখেছেন, ‘...দুনিয়ার যে কোনো যুদ্ধেই শহীদের প্রকৃত সংখ্যা পাওয়া মুশকিল। ইতিহাসবিদরা জনশুমারি ও অন্যন্য মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যে যে ৩০ লাখ মানুষ শহীদের কথা বলে আসছেন, তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি প্রতিষ্ঠিত সংখ্যা এবং জাতীয়ভাবে গৃহীত। এখন এ সংখ্যাটি যারা বিতর্কিত করতে চান, তারা সময় সুযোগ পেলে মুক্তিযুদ্ধটাকেই গিলে ফেলবেন।’ সপ্তম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইটির সবশেষ পরিমার্জনের কাজ কারা করেছেন, বইয়ে উল্লেখ নেই। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘প্রত্যেকটি বিষয়ের কাজ করার জন্য বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তারা পরিমার্জনের কাজ করেছেন। কোথাও যদি কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়, তা সংশোধনী দেয়া হবে। দ্রুত কাজ করতে গিয়েও কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটতে পারে। আমরা বিষয়টি দেখব।’