সুসংবাদ প্রতিদিন

পান চাষে আগ্রহ বাড়ছে

প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  মোশারফ হোসাইন, নকলা (শেরপুর)

অল্প জমিতে কম খরচে বেশি লাভ পাওয়ায় শেরপুরের নকলা উপজেলায় দিন দিন পান চাষের পরিমাণ ও চাষির সংখ্যা বাড়ছে। ধান, গম, ভূট্টা ও আলুসহ অন্যান্য ফসলের চেয়ে পান চাষে অধিক লাভ হওয়ায় অনেকেই পান চাষে ঝুঁকছেন। আগ্রহী হয়েছেন অনেকেই। উপজেলার গণপদ্দী, নকলা, বানেশ্বরদী, পাঠাকাটা ও টালকী ইউনিয়নসহ পৌর এলাকার বেশকিছু গ্রামের কৃষকরা নিজের মেধা, শ্রম ও উদ্যোগে পান চাষ করে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন। এরমধ্যে বানেশ্বরদী ও পৌর এলাকার বেশ কয়েকজন পানচাষি কয়েক বছর ধরে সব আবাদ বাদ দিয়ে শুধুই পান চাষ করছেন। বিঘাপ্রতি পানের বরজে কম-বেশি ১ লাখ টাকা খরচ করে পরবর্তী বছর থেকে চাষিরা বছরে লাভ করছেন আড়াই লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা। যা অন্যকোনো আবাদে সম্ভব নয়। বানেশ্বরদী ইউনিয়নের বানেশ্বরদী উত্তরপাড়া এলাকার মৃত আব্দুল খালেকের ছেলে পুরাতন পানচাষি আজাহার আলী জানান, ধানসহ যেকোন আবাদের তুলনায় পান চাষে অল্প জমিতে কম খরচে বেশি লাভ পাওয়া যায়। তারা তিন ভাই ১৯৮৩ সাল থেকে পান চাষ করছেন। তার বাপ-দাদারাও ধান, গম, ভূট্টার পরিবর্তে পান চাষ করতেন। বর্তমানে তাদের তিন ভাইয়ের সবাই পান চাষ করে এলাকায় ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তাদের টাকার যেন কোন অভাব নেই, সবার পরিবারেই সুখ আর সুখ। তথ্য মতে, আজাহার আলীর ৮ আনা বরজ আছে। তার ভাই আক্কেল আলী ও আনসার আলী দুইজনেরই ১১ আনা করে পানের বরজ আছে। আজাহার আলী বলেন, একআনা পানের বরজে প্রায় সোয়া শতাংশ জমি লাগে। আমার ১০ শতাংশ জমিতে ৮ আনা পানের বরজ করেছি। তাছাড়া আমার ভাই আক্কেল আলী ও আনসার আলী দুইজনেই প্রায় ১৫ শতাংশ জমিতে পানের বরজ করেছেন। ১০-১৫ শতাংশ জমিতে পানের বরজ করে বছরে কয়েক লাখ টাকা আয় করা যায়। যা অন্যকোন আবাদে কল্পনাও করা যায় না। তাই তাদের দেখাদেখি এলাকার অনেকেই পানের বরজে ঝুঁকছেন। কেউ কেউ নতুন বরজ করে সফলতার মুখ দেখছেন বলে তিনি জানান।

অন্য এক পান বরজ মালিক মৃত আব্দুস সাত্তারের ছেলে আব্দুর রহিম জানান, উপজেলায় সবচেয়ে পুরাতন পান বরজের মালিক বানেশ্বরদীর মৃত আব্দুল খালেক ও তার ছেলেরা। তাদের দেখাদেখি বানেশ্বরদী এলাকায় এখন ছোট-বড় অন্তত ৮-১০টি পানের বরজ গড়ে উঠেছে। প্রতিটি বরজ মালিক আজ স্বাবলম্বী, তাদের পরিবারে এসেছে সুখ-শান্তি। এখন তারা সবাই এলাকার ধনীলোকদের তালিকায়। আব্দুর রহিম বলেন, আমি সাড়ে ২২ শতাংশ জমিতে ১৮ আনা পানের বরজ করেছি। এ থেকে যে আয় হয়, তা দিয়ে সংসারের সব খরচ চালানোর পরে বছরে অন্তত কয়েক লাখ টাকা সঞ্চয় হয়।

সম্প্রতি সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বানেশ্বরদী ইউনিয়নের আজাহার আলী, আক্কেল আলী, আনসার আলী, আব্দুর রহিম ছাড়াও মৃত আলীম উদ্দিনের ছেলে আমির উদ্দীন ১৪ আনা পানের বরজ করেছেন। মৃত মমতাজ আলীর ছেলে আব্দুস সাত্তার ৬ আনা ও আব্দুস সাত্তারের ছেলে রবিন মিয়া করেছেন ৮ আনা পানের বরজ।

আজাহার আলী বলেন, আমি গত বছর ১৬ আনা বরজ করেছিলাম, কিন্তু বন্যায় নষ্ট হয়েগেছে। তাতে ৪-৫ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। এর পরে বরজ ছোট করেছি। এখন ৮ আনার বরজ আছে। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন না হলে ৮ আনার বরজ হতে তথা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ জমিতে বছরে ৪-৫ লাখ টাকার পান বিক্রি করা সম্ভব। তিনি জানান, তার দুই ভাই আক্কেল আলীর ও আনসার আলী তাদের ১১ আনাতে গত ৩ মাসে প্রায় লাখ টাকা করে পান পাতা বিক্রি করেছেন।

পান চাষি আমির উদ্দীন বলেন, পানের বরজে অন্যান্য ফসলের তুলনায় পরিশ্রম বেশি লাগলেও অল্প জমিতে কম খরচে বেশি লাভ পাওয়া যায়। কয়েক বছর ধরে সারাবছর পানের দাম ভালো থাকায় আমরা পান বরজের মালিকরা সবাই অন্যদের তুলনায় পরিবার পরিজন নিয়ে ভালো আছি। তবে কৃষি অফিস থেকে পরামর্শসহ প্রয়োজনীয় আনুসঙ্গিক সহযোগিতা পেলে উপজেলার অনেক ক্ষুদ্র কৃষক অল্প জমিতে পানের বরজ করে স্বাবলম্বী হতে পারতেন, সংসারে সুখ আসতো সুখ। তারা একসময় বড় পরিসরে পানের বরজ করতে পারতেন। এতে একদিকে পরিবারে আসতো সুখ-শান্তি, অন্যদিকে কৃষি অর্থনীতি হতো অধিক সমৃদ্ধ।

পান চাষিদের দেওয়া তথ্য মতে, পানের বরজ গড়তে নতুন অবস্থায় বাঁশের ৪টি শলাতে ১ গাছ হিসেব করা হয়। ৬ মাস পরে প্রতিটি গাছের বা ৪ শলার ভেতরে আরো ৪টি শলা দেয়া হয়। তাতে ৬ মাস পরে ৮ শলাতে ১ গাছ ধরা হয়। এমন ১০০টি গাছে বা ৮০০টি শলাতে ১ আনা হয়। তাদের দেওয়া হিসেবে মতে, ৮ আনার বরজে প্রথম ৬ মাসে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা ব্যয় হয়। উল্লেখযোগ্য ব্যয়ের মধ্যে, পানের পর বা লতি ক্রয় বাবদ ৩০ হাজার টাকা, খুঁটি বা শলা দিতে বাঁশ বাবদ অন্তত ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা, ভেড়া ও ছাউনি দিতে ১৫ হাজার থেকে ১৭ হাজার টাকা, জৈব সার হিসেবে গোবর ও সামান্য কিছু রাসায়নিক সার বাবদ আরো অন্তত ৫ হাজার টাকা লাগে। এছাড়া ৮ আনা বরজে বছরে অন্তত ২২ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকার মাটি লাগে। পানের নতুন পর বা লতি রোপনের পরে ৫-৬ মাসের মধ্যে পান পাতা বিক্রি করার উপযোগী হয়। তবে পান পাতা তুলা পর্যন্ত ৮ আনার বরজে শ্রমিক মজুরিসহ সব মিলিয়ে অন্তত ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয় চাষিদের।

বরজ মালিক আনসার আলী জানান, নকলাতে আগে পান বরজের শ্রমিক পাওয়া যেতো, তবে এখন নকলাতে বরজ শ্রমিক নেই। তাই শেরপুর সদর উপজেলার সূর্যদী এলাকা থেকে শ্রমিক আনতে হয়। প্রতি শ্রমিকের খাওয়া বাদেই মৌসুম ভেদে মজুরি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। সাধারণত কার্তিক মাসে নতুন করে বরজে পানের পর বা লতি রোপণ করতে হয়। আর চৈত্র-বৈশাখ মাস থেকে অল্প অল্প করে পান পাতা তুলা শুরু করা হয়। বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত পানের ভড়া মৌসুম; তাই এ সময় দাম কিছু কম থাকে। তবে ভাদ্র থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত পানের উৎপাদন কম হওয়ায় দাম বরাবরই বেশি থাকে।

বানেশ্বরদী গ্রামের পানের পাইকারি আব্দুছ সাত্তার জানান, ৮০টি পানে এক ভীরা হিসেব করা হয়। পানের আকার ভেদে প্রতি ভীরা (৮০ পান) পানের বর্তমান পাইকারি দান ৩০ টাকা থেকে ২২০ টাকা। আর প্রতি ভীরা পানের খুচরা দাম ৪০ টাকা থেকে ২৮০ টাকা। তিনি বলেন, আমরা বরজ মালিকের বাড়ি থেকে বা সরাসরি বরজ থেকে পান কিনে নিয়ে বিভিন্ন বাজারে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করি। আমরা বিভিন্ন বাজারের ছোট ও মাঝারি পাইকারদের কাছে অল্প লাভে পাইকারি বিক্রি করি। খুচরা প্রতি ভীরাতে ১০ থেকে ২০ টাকা লাভে এবং পাইকারি প্রতি ভীরাতে ৫ থেকে ১০ টাকা লাভে বিক্রি করে থাকি। তিনি জানান, তার মতো বানেশ্বরদীর জুব্বার আলী, হোসেন আলী ও শহীদ মিয়া, ভূরদী এলাকার শফিক, শরাফত, আকাব্বর আলী ও মন্ডলসহ অনেকেই খুচরা ও পাইকারি পানের ব্যবসা করেন।

ভৌগোলিক অবস্থান ও পান বরজের উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে এ অঞ্চলের চাষিরা অর্থকরী ফসল হিসেবে পান চাষ করে আসছেন। অন্য ফসল চাষাবাদের পাশাপাশি উপজেলার অর্ধশতাধিক কৃষি পরিবার পান চাষের সাথে জড়িত আছেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিন মেহেদী জানান, পানের আবাদ বাড়াতে ও কৃষি অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধ করতে তারা কৃষকদের সাথে নিয়মিত কাজ করছেন। জৈব পদ্ধতিতে নিরাপদ পান উৎপাদনে কৃষি অফিস থেকে পান চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। পান চাষকে আরো সমৃদ্ধ করতে পারলে চাষির সংখ্যা ও পান বরজের পরিমাণ বাড়বে, তৈরি হবে নতুন নতুন কৃষি উদ্যোক্তা। এতেকরে সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান এবং কিছুটা হলেও কমবে বেকারত্বের চাপ। এমনটাই মনে করছে শিক্ষিত কৃষক ও বিভিন্ন স্তরের কৃষি কর্মকর্তারা।