ঢাকা ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ৩০ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুসংবাদ প্রতিদিন

কোকোপিট চারায় বদলে যাচ্ছে কৃষির চিত্র

কোকোপিট চারায় বদলে যাচ্ছে কৃষির চিত্র

মাটির স্পর্শ ছাড়াই কোকোপিট পদ্ধতিতে প্লাগ ট্রেতে বা প্লস্টিকের ট্রেতে কোকোডাস্ট ও জৈবসার ব্যবহার করে শাকসবজি ও ফল-ফুলসহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদিত চারায় লাভবান হচ্ছেন কৃষক সুবিধা ভোগ করছেন সবাই। এ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করে পার্শ্ববর্তী জেলা-উপজেলায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন শেরপুর জেলার নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের চরমধুয়া গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা শাউদা মোসলেউর রহমান সৌমিক ও পৌরসভার চরকৈয়া এলাকার কৃষক ফরিদ উদ্দিন। সৌমিক বলেন, আমি এসএসসি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত সকল পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছি। অর্থনীতি বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে অনার্স-মাস্টার্স পাস করেও সরকারি-বেসরকারি কোনো চাকরির জন্য একটি আবেদনও করিনি। সৌমিক প্রমাণ করেছেন উচ্চ শিক্ষিত হলেই চাকরির পিছনে দৌড়াতে, হবে তা ঠিক না। পরিকল্পিতভাবে প্লাগ ট্রেতে কোকোডাস্ট ও জৈবসার ব্যবহার করে শাক-সবজি ও ফল-ফুলসহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন।

কৃষক ফরিদ উদ্দিন বলেন, কৃষি বিভাগ থেকে পলিনেট পাওয়ার পরে সেখানে উচ্চ মূল্যের ফসল উদপাদনে পাশাপাশি প্লাগ ট্রেতে কোকোডাস্ট ও জৈবসার ব্যবহার করে অধিক লাভবান হচ্ছি। এতে সারা বছর কৃষক ও ছাদ ওয়ালা পাকা ভবনের মালিকরা ২০-২৫ দিনের ভালো মানের চারা পাচ্ছেন। দিন দিন এই চারার আগ্রহ বাড়ছে। এই চারা থেকে বছরে অর্ধ লক্ষ টাকা তাদের আয় হয়। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, ইচ্ছা শক্তি, মেধা ও দৃঢ় সংকল্প থাকলে যে কোনো ক্ষেত্রে পরিশ্রম করে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব। তাতে সফল উদ্যোক্তার সুপরিচিতি পাওয়া যায়। এমনটাই প্রমাণ করেছেন অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী শাউদা মোসলেউর রহমান সৌমিক। তিনি চাকরির আবেদন না করলেও কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার নেশায় ও চাকরি দাতা হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে কৃষি বিভাগ ও প্রাণিসম্পদ বিভাগসহ বিসিক, যুব উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মতো বেশ কয়েকটি দপ্তর-অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন মেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। এসব প্রশিক্ষণ লব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই আজ সে সফল কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে সর্বমহলে পরিচিতি পেয়েছেন। হয়েছেন আত্মনির্ভশীল, পরিণত হয়েছেন চাকরি দাতা হিসেবে।

তার মৌমাছির খামারে, ফুল-ফল ও চারা উৎপাদনের নার্সারিতে, গরু ও মুরগির খামারে এবং ফলজ ও কাঠের বাগানে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় কর্মসংস্থানের সন্ধান পেয়েছেন অনেকে। নতুন করে আধুনিক প্রযুক্তিতে মাটির ব্যবহার ছাড়াই কোকোপিট পদ্ধতিতে প্লাস্টিকের ট্রের (প্লাগট্রে) মধ্যে কোকোডাস্ট ও জৈবসার ব্যবহার করে শাক-সবজি ও ফল-ফুলসহ বিভিন্ন ফসলের চারা উৎপাদন শুরু করে সবার নজর কেড়েছেন। আর সৌমিকের এই পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনের সুবিধা ভোগ করছেন বিভিন্ন এলাকার ছোট-বড় সব ধরনের কৃষক। বিশেষ করে ছাদ বাগানে তার উৎপাদিত চারা বেশি ব্যবহার করা হয়। সৌমিকের কাছে ১৫-২০ দিন বয়সি ও চাহিদা মোতাবেক চারা স্বল্প মূল্যে পেয়ে সবাই খুশি। এতে কৃষকদের আলাদাভাবে চারা উৎপাদন করতে হচ্ছে না। ফলে জমি নির্বাচন, বীজতলা তৈরি, বীজ ও সার, সেচ, পরিচর্যা ও আলাদা সময় ব্যয় করতে হচ্ছে না কৃষকদের। বরং স্বল্প মূল্যে ১৫-২০ দিন বয়সি নিরোগ চারা পাচ্ছেন তারা। তাই এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারার চাহিদা ও কৃষকের আগ্রহ অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। সরেজমিন সৌমিকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সে প্লাগ ট্রেতে নারিকেলের ছোবড়া (কোকোডাস্ট) ও শুকনা জৈবসারের মিশ্রণের মধ্যে বিভিন্ন জাতের বীজ বপন করছেন। এই পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করে তার সারা বছর আয় হয় বলে তিনি জানান। প্লাগ ট্রেতে মাটি ব্যবহার করলে তা ভারি হয়ে যায় এবং সেচের দরকার হয়। তাই পানি ধারণ ও নিষ্কাশন ক্ষমতাসম্পন্ন কোকোপিট ব্যবহার করা হয়। এই প্রযুক্তিটি এক ধরনের হাইড্রোপনিকস প্রযুক্তি হিসেবেও পরিচিত।

শাউদা মোসলেউর রহমান সৌমিক জানান, এই পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনে মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকায় রোগবালাইয়ের আক্রমণ নেই বললেই চলে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদিত এসব চারা কৃষকদের মাঝে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করেন তিনি। তিনি জানান, ক্যাপসিক্যাম, স্ট্রবেরি, হাইব্রিড জাতের মরিচ, বেগুন, লাউ, কুমড়া, তরমুজ, বাঁধাকপি, ফুলকপিসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নত জাতের ফল ও ফুলের চারা উৎপাদন করা হচ্ছে এই পদ্ধতিতে। এতে সব খরচ বাদ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা লাভ থাকে তার। ট্রেতে বীজ বপন শেষে বিশেষ কৌশলে নেট দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ফলে কোনো ধরনের কীটপতঙ্গ চারাগাছকে আক্রমণ করতে পারে না। ফলে চারাগুলো সুস্থ ও সবলভাবে বেড়ে ওঠে।

উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে তাল মেলাতে বিভিন্ন সবজির উৎকৃষ্ট গুণমানের ও অসময়ে সবজি চাষের প্রচলন বেড়েছে। বিভিন্ন রোগ ও কীটশত্রু সহনশীল, উচ্চফলনশীল উচ্চ দামের সবজির চারা তৈরির জন্য বর্তমানে প্লাগ ট্রে বা পোর ট্রে বহুল ব্যবহার হচ্ছে। এই প্রযুক্তির প্রধান উপাদান হলো চারা তৈরির প্লাস্টিকের ট্রে। এতে ছোট টবের আকৃতির খোপ থাকে। খোপে মাটি না দিয়ে বিশেষ গ্রোথ মিডিয়াম (কোকোপিট) দিয়ে ভরা হয়। পরে প্রতি খোপে একটি করে বীজ রোপণ করে চারা তৈরি করা হয়। এই খোপগুলোকে প্লাগ বা পোর বলে। প্রতিটি প্লাগের তলায় টবের মতোই পানি নির্গমনের জন্য ছোট ছোট ছিদ্র থাকে। স্বল্পকালীন সবজি ফসলের জন্য সাধারণভাবে যেসব ট্রে ব্যবহার করা হয় তাতে ৯৮টি বা ১০২টি বা ১০৪টি করে খোপ বা প্লাগ থাকে। তবে বর্তমানে সবরকম চারা উৎপাদনের জন্য অপেক্ষাকৃত বড় আকারের খোপবিশিষ্ট প্লাগ ট্রে বাজারে পাওয়া যায়।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিম মেহেদী বলেন, মাটির স্পর্শ ছাড়াই কোকোপিট পদ্ধতিতে প্লাগ ট্রেতে কোকোডাস্ট ও জৈবসার ব্যবহারে পরিকল্পিতভাবে সহজেই নিরোগ চারা উৎপাদন সহজ। কোকোডাস্টের পানি ধারণক্ষমতা বেশি। তাই খুব সহজেই সতেজ যে কোনো বীজ থেকে চারা গজায়; যা সুস্থ, সবল ও বালাইমুক্ত। এই পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন মাঠ পর্যায়ে বিস্তার ঘটাতে পারলে সবাই আগ্রহী হবেন। ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে; কমবে বেকারত্ব, সমৃদ্ধ হবে দেশের কৃষি অর্থনীতি। এ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করে শিক্ষিত তরুণসহ যে কেউ স্বাবলম্বী হতে পারেন বলে তিনি মনে করেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত