নিম্ন আয়ের মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) তেল, ডাল ও চাল বিক্রি করে আসতো। এতে প্রতিদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামে সাড়ে ২৪ হাজার মানুষ ভর্তুকি মূল্যে এসব পণ্য কেনার সুযোগ পেতেন। গত ৩১ ডিসেম্বর টিসিবির ট্রাক সেল বন্ধ করা হয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ কষ্টে আছেন। এ অবস্থায় টিসিবির ট্রাক সেলের মতো কর্মসূচি আরো বাড়ানো প্রয়োজন। উল্টো এসব কর্মসূচি বন্ধে গরিব মানুষের কষ্ট আরো বেড়ে যাবে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ফজর আলী নিয়মিত টিসিবির ট্রাক থেকে চাল, ডাল ও তেল নিতেন। কিন্তু হঠাৎ করে টিসিবির ট্রাক সেল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি। শনিরআখড়ায় বসবাসকারী আশরাফ তালুকদার, যাত্রাবাড়ীর সেফালি বেগম ও মিরপুর এলাকার বাসিন্দাদের একই অবস্থা। এরা সবাই দিনমজুর বা বাসাবাড়িতে কাজ করা মানুষ। টিসিবির ট্রাক থেকে প্রতি মাসে চাল, তেল ও ডাল পাওয়া তাদের চিন্তামুক্ত থাকতে সহায়ক ছিল। ‘ঘরে ভাত-ডালের নিশ্চয়তা থাকলে কাজে মন বসে, মাথাটা ভালো কাজ করে’, বলেও জানান তারা। কিন্তু এখন তাদের চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কপালে। কারণ টিসিবি খোলা ট্রাকের মাধ্যম এসব পণ্য বিক্রি কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। বাজার থেকে দ্বিগুণ দামে চাল, তেল ও ডাল কেনা অনেকটাই কষ্টসাধ্য হবে বলে মনে করেন তারা। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘নতুন করে ভ্যাট আরোপ, সরকারের নির্দয় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে নাগরিক সমাবেশ’-এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, টিসিবির যেসব কার্ড বন্ধ করা হয়েছে সেগুলো অবিলম্বে চালু করতে হবে। জিনিসপত্রের দাম কমানোর ব্যাপারে এই সরকারের কোনো উদ্যোগ আমরা দেখিনি। পাঁচ মাসে এ সরকারের কোনো সাফল্য নেই। অর্থনীতিতে যিনি নোবেল পেয়েছেন, তিনি অর্থনীতিকে কোনো গতি দিতে পারেননি। ড. ইউনূসকে খুবই সম্মান করি। কিন্তু যেটা বাস্তব সেটা বলতে হবে।
শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর আরোপ, টিসিবির ট্রাক সেল বন্ধ ও ৪৩ লাখ পরিবারের ফ্যামিলি কার্ড বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। সমাবেশ থেকে গ্রাম-শহরে শ্রমজীবীদের জন্য রেশন ও ন্যায্যমূল্যের দোকান চালুর দাবি জানিয়েছে দলটি। ঢাকা মহানগর শাখার উদ্যোগে গত সোমবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করেছে।
সম্প্রতি কয়েকমাস বন্ধ থাকার পরে গত অক্টোবর মাসে ট্রাকে করে তেল, ডাল ও চাল বিক্রির কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল টিসিবি। ফলে পরিবার কার্ড না থাকলেও প্রতিদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামে সাড়ে ২৪ হাজার মানুষ ভর্তুকি মূল্যে এসব পণ্য কেনার সুযোগ পেতেন। মাত্র দুই মাস সাত দিন চলার পরে এ কর্মসূচি বন্ধ করে দিয়েছে সংস্থাটি। তবে সারা দেশে ১ কোটি পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে টিসিবির পণ্যের কর্মসূচিটি চালু থাকবে বলেও জানিয়েছে টিসিবি কর্তৃপক্ষ।
সংস্থাটি সংশ্লিষ্টরা জানান, নিম্নআয়ের মানুষের জন্য টিসিবির ট্রাকে করে ভর্তুকি দেয়া পণ্য বিক্রির নির্ধারিত শিডিউল শেষ হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতির এই বাজারে বাড়তি আর্থিক চাপ সামলাতে না পেরে অনেক সুবিধাভোগী আবারো টিসিবির ট্রাক সেল কর্মসূচি চালুর দাবি জানিয়েছেন। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আপাতত এ কর্মসূচি চালুর কোনো পরিকল্পনা সরকারের নাই। বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে, তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা নেই। শুরুতে এ কার্যক্রম ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত চালু থাকার কথা থাকলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সে হিসেবে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলেছে, জানুয়ারি থেকে বন্ধ হয়ে গেছে টিসিবির ট্রাক সেল কার্যক্রম।
উল্লেখ্য, গত ২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকা মহানগরীতে ৫০টি ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে ২০টি ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে অর্থাৎ ১০০ টাকা লিটার দরে তেল, ৬০ টাকা কেজি দরে মসুর ডাল ও ৩০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল টিসিবি। এই কার্যক্রমের আওতায়, একজন ভোক্তা সর্বোচ্চ ২ লিটার ভোজ্যতেল ২০০ টাকায়, ২ কেজি মসুর ডাল ১২০ টাকায় এবং ৫ কেজি চাল ১৫০ টাকায় কিনতে পারতেন। বর্তমানে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা, প্রতি কেজি মসুর ডাল ১১০ থেকে ১১৫ টাকা ও প্রতি কেজি চাল ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে শুধু স্মার্ট কার্ডধারী পরিবারকেই পণ্য দেবে টিসিবি। এক্ষেত্রে এক কোটি কার্ডধারী পরিবারের মধ্যে শুধু ৫৭ লাখ স্মার্ট কার্ডধারী এ সুবিধা পাবেন। বাকি ৪৩ লাখ পরিবারের কাছে স্মার্ট কার্ড না থাকায় তারা সরকারের এই সুবিধা আপাতত পাবেন না। টিসিবির পণ্য কেনার জন্য একটি পরিবারকে এতদিন একটি সাধারণ কাগুজে কার্ড দেওয়া হতো। পুরোনো এই কার্ড বাতিল করে এখন স্মার্ট কার্ডের বিপরীতে পণ্য বিতরণ শুরু করেছে টিসিবি।
এ প্রসঙ্গে টিসিবির চেয়ারম্যানের মুখপাত্র হুমায়ুন কবির জানিয়েছেন, ট্রাক সেল কার্যক্রম কিন্তু সারা বছর চালানো হয় না। যখন মূল্যস্ফীতি বেশি থাকে বা কোনো পণ্যের বিশেষ চাহিদা থাকে, তখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় টিসিবি ট্রাক সেল কার্যক্রম পরিচালনা করে। তার অংশ হিসেবে অক্টোবরে ২৮ হাজার পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নভেম্বর পর্যন্ত এটা চলমান থাকার কথা থাকলেও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় তা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। টিসিবি নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না। টিসিবি সংক্রান্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত টিসিবি কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করে।