দেশজুড়ে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ বৈধ পণ্যের মতোই ব্যবহার করছেন মানুষ। গত বছরের নভেম্বরে পলিথিন ব্যাগের লাগাম টানার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিলে পলিথিন ব্যাগ বন্ধে একযোগে বাজারের পাশাপাশি করখানাগুলোয় অভিযান চালাতে যাচ্ছে সরকার। পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনকারী কারখানায় অভিযান চালানো হয়েছিল। অভিযানে গেলেই দেখা যেত এসব কারখানা আওয়ামী লীগ নেতাদের ছত্রছায়ায় গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে চাপের মুখেই নামমাত্র কিছু কারখানায় জরিমানা করে অভিযান থেকে ফিরে আসতে হয়েছে। তবে এবার অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকায় পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনকারী কারখানায় জোরেশোরে অভিযান চালানো সম্ভব হবে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পুরান ঢাকার দেবীদাসে কোথাও প্লাস্টিক পণ্য রিসাইকেল করে প্লাস্টিক দানা, কোথাও পলিথিনের রোল আবার কোথাও পলিথিনের ব্যাগ তৈরি করা হচ্ছে। একই অবস্থা পুরান ঢাকার চকবাজার, লালবাগ, ইসলামবাগ, কামালবাগ, চানখাঁরপুল, সোয়ারীঘাটে। পুরান ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার কারখানায় কমবেশি দেড় কোটি পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন হচ্ছে। একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়ায় দিনে দিনে পলিথিন ব্যাগের স্তূপ বেড়েছে ব্যাপক হারে। নদীতে বিপুল পরিমাণে পলিথিন, প্লাস্টিক ও অপচনশীল বর্জ্যের স্তূপ। এসব বর্জ্য নদীর পানিতে মিশে যাচ্ছে। সদরঘাটে যাত্রী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অবলীলায় পলিথিন ব্যাগ ও পানির বোতল, প্লাস্টিকের সামগ্রী সরাসরি নদীতে ফেলছেন। এছাড়া যাত্রীবাহী লঞ্চগুলো ঘাটে নোঙরের পর আবর্জনা ঝাড়ু দিয়ে ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গায়।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবহারের পর যত্রতত্র ছুড়ে ফেলা প্লাস্টিক সময়ের সঙ্গে ক্ষয় হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তরিত হয় (দৈর্ঘ্যে ৫ মিলিমিটারের চেয়েও ছোট) এবং পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে মানুষ ও বাস্তুতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য ঝুঁকির সৃষ্টি করে। পলিথিন প্রাকৃতিক পরিবেশে দিনের পর দিন পড়ে থাকলেও কোনো ক্ষয় হয় না এবং এটি আমাদের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়েছে। যা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। দেশের নদী থেকে প্রতিদিন ৫৪৭ টন মাছ ধরা হয়। অথচ শুধু পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা থেকে প্রতিদিন কমবেশি ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক আসে। একসময় প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া পলিথিন ব্যাগে এখন বাজারভর্তি। পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। বাজার তদারকিও নেই। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ থাকে একেবারেই অপ্রতুল। মগবাজার কাঁচা বাজারে আলু কিনতে এসেছিলেন আফরিন জাহান। পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ জানলেও দোকানী তাকে পলিথিন ব্যাগেই আলু দিচ্ছেন। এ সময়ে আফরিন জাহান বরেন, পলিথিন বন্ধ হলে ভাল হতো। আগের মতোই হাতে করে কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বাজারে আসা যেত। কিন্তু এখন পলিথিনের বিকল্প ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, যা আছে তাও চড়া দাম। সেজন্য ফ্রিতে পলিথিন ব্যাগেই বাজার করতে হয়। আফরিন জাহানের মতো শহরের বহু ক্রেতা পলিথিন ব্যাগ নিয়ে সচেতন। পলিথিন ব্যাগের বিপদ সম্পর্কে তারা জানেন, এসব সামগ্রীর ব্যবহার যে পুরোপুরি বন্ধ হওয়া দরকার সেটাও মানেন। অনেকে আবার সেসব নিয়ে অতটা মাথা ঘামাতে চান না। পলি ব্যাগের সহজ জীবন কঠিন হয়ে উঠবে, তা মানতে তাদের অস্বস্তি। পলিথিন না থাকলে রান্নাঘরের প্রতিদিনের ময়লা ফেলার উপায় কী হবে, সেটাও ভাবছেন কেউ কেউ। বাংলাদেশে আইন করে সাধারণ পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেই ২০০২ সালে। সে আইন কেবল কিতাবেই থেকে গেছে। বরং পলিথিনের অতি ব্যবহার পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পলিথিনের শপিং ব্যাগ পচনশীল নয়। পলিথিনের স্তূপ নালায় আটকে থাকায় পানি নিষ্কাষণেও বাধা তৈরি হয়। সে কারণে বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা এক সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
গত ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা পলিথিন নিষিদ্ধের আইনের কঠোরভাবে প্রয়োগের ঘোষণা দেন। এর অংশ হিসেবে গত ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে এই ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। আর ১ নভেম্বর থেকে কাঁচা বাজারেও পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিনের ব্যাগ (টিস্যু ব্যাগ) ব্যবহার করা যাবে না। এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে কাঁচাবাজারগুলোতে চালানো হয় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। কিন্তু পলিথিন ব্যাগ বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
আইন বলছে, পলিথিন বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুত, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের দায়ে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে দুই থেকে দশ বছরের কারাদণ্ড, দুই লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে।
২০২৩ সালে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল ঢাকা শহরে প্রতিদিন আড়াই কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হয়। ঢাকায় এক একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে পাঁচটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। দেশে প্রতিদিন ৩৫ লাখের বেশি টিস্যু ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাত হয়। এসব ব্যাগ কৃত্রিম তন্তু দিয়ে তৈরি হলেও কাপড়ের ব্যাগ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।
কারওয়ান বাজার পাইকারি কাঁচা বাজার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুজন বলেন, সবারই দেশের আইন মেনে ও পরিবেশ রক্ষা করে ব্যবসা করতে হবে। এর জন্য ব্যবসায়ীদের ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি দিয়ে পাট ও চটের ব্যাগ দোকানে রাখতে হবে অথবা ক্রেতাদের সঙ্গে করে ব্যাগ আনতে হবে। সবার মিলিত সিদ্ধান্ত এলে ভালো হয়।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অবশ্য বলেছিলেন, পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিনের ব্যাগ ব্যবহার বন্ধে ‘পর্যাপ্ত সময়’ দেয়া হয়েছে। আর সরকারও বিকল্প সরবরাহের জন্য কাজ করছে। পরিবেশ উপদেষ্টা এও বলেছিলেন, সতর্ক করা এবং কঠোর হওয়ার সময় পার হয়ে গেছে। অভিযানে কঠিন শাস্তি ও জরিমানার বিধান রয়েছে। তবে শাস্তি দেয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। ক্ষতিকর এই ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। আশা করি অভিযান চালিয়ে শাস্তি দেয়ার দরকার হবে না। এই ঘোষণাতেই সচেতনতা তৈরি হবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে সারাদেশে পলিথিনের শপিং ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করতে চায় সরকার। সে লক্ষে কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে কারখানা পর্যায়ে অভিযান এবং মনিটরিং করছে পরিবেশ অধিদপ্তর।