ঝুলছে গণপূর্ত ক্যাডার উন্নীতকরণ ফাইল
প্রকাশ : ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ফারুক আলম
চাকরির পরীক্ষার শুরু থেকেই বিসিএসের প্রতি প্রবল আগ্রহী ছিলেন শফিকুল ইসলাম (ছদ্ম নাম)। বুয়েটে লেখাপড়া করায় গণপূর্ত ক্যাডারের বাইরে অন্য কোনো চাকরি করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ফলে ১৮তম বিসিএসে অংশ নিয়েই চূড়ান্ত ফলাফল দেখতে পান গণপূর্ত ক্যাডারে। বহু স্বপ্ন নিয়ে শফিকুল ইসলাম ১৮তম ব্যাচের গণপূর্ত ক্যাডারে চাকরিতে যোগদান করেন। তবে, পদোন্নতি পেয়ে গ্রেড-৪ প্রাপ্ত হলেও তার একই ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা অনেকেই গ্রেড-২ এ পদোন্নতি পেয়েছেন। প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে গণপূর্ত ক্যাডারের বৈষম্যদূরীকরণে সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় গড়িমসি করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। গণপূর্ত অধিদপ্তরের কয়েকজন প্রকৌশলী জানান, বিসিএস ১৮তম ব্যাচের গণপূর্ত ক্যাডার প্রশাসন ক্যাডারের সাথে সমতা বিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রেড-২ তে পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করলেও পদোন্নতি না পাওয়ায় সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন এবং মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে কর্মস্পৃহা হ্রাস পেয়েছে। ক্যাডার বৈষম্যদূরীকরণে ন্যায়বিচার চেয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর পদকে গ্রেড-৩ এবং অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদকে গ্রেড-২ তে উন্নীত করার জন্য হাইকোর্টে মামলা করা হয় (মামলা নং-১০৬৩১/২০১২)।
মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ ২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর পদকে গ্রেড-৩ এবং অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদকে গ্রেড-২ তে উন্নীত করার নির্দেশনা দিয়ে রায় প্রদান করেন এবং ২ মাসের মধ্যে রায় বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন। হাইকোর্টের রায় বাতিল চেয়ে সরকার সুপ্রিমকোর্টের আপীল বিভাগে লিভ টু আপীল মামলা দায়ের করেন (মামলা নং-২৩৮৯/২০১৯)। আপীল বিভাগ সরকারের লিভ টু আপীল মামলা খারিজ করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। পরবর্তীতে সরকার রিভিউ মামলা দায়ের করেন। আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ ব্যাঞ্চ রিভিউ মামলা খারিজ করে দেন। ফলে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে এবং রায় বাস্তবায়নে আর কোন আইনি বাধা নেই। হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়। এরপর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের পক্ষে সুস্পষ্ট মতামত প্রদান করার পরও অজ্ঞাতকারণে এখনও রায় বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে আবেদনকারী চাকরিতে গ্রেড-৩ পাইনি। চাকরিতে বৈষম্যদূরীকরণের লক্ষ্যে গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের নিকট গ্রেড-৩ প্রাপ্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গণপূর্তের বিসিএস প্রকৌশলীরা আবেদন করেছেন। সেখানে বিসিএস (গণপূর্ত) ক্যাডারের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশণী এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদকে যথাক্রমে গ্রেড-২ ও গ্রেড-৩-এ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী উন্নীতকরণের দাবি জানিয়েছেন।
নথি পর্যালোচনায় করে দেখা গেছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী পদকে গ্রেড-১, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদকে গ্রেড-২ এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদকে গ্রেড-৩ এ উন্নীতকরণের জন্য তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী মো. কবির আহমেদ ভূঁইয়া ২০১২ সালে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন নং-১০৬০১/২০১২ দায়ের করেন। উক্ত রিট পিটিশনে হাইকোর্ট বিভাগ আবেদনকারীগণের পক্ষে ২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর রায় প্রদান করলে উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল নং-২৩৮৯/২০১৯ দায়ের করলে ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তামাদির বিলম্বজনিত কারণে তা খারিজ হয়। অতএব, আপিল বিভাগে সিভিল রিভিউ পিটিশন নং- ৮৯/২০২২ দায়ের করা হলে ২০২২ সালের ৯ জুন রিভিউ পিটিশনটি খারিজ হয়। এরপরও সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনীহা চলতে থাকে। এ প্রেক্ষিতে সরকার পবির্তনের সুযোগ নিয়ে মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা আইনি মারপ্যাঁচে বিষয়টি ঝুলিয়ে দেয়ার অপতৎপরতা শুরু করে। এ প্রক্রিয়ায় আইনি মতামত নিতে নতুন করে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে চিঠি দেয়া হয়।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান স্বাক্ষরে চিঠির জবাবও গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আইন কর্মকর্তা বরাবর প্রেরণ করা হয়। সেখানে সুস্পষ্টভাবে আইনের ধারাবাহিকতা উল্লেখ করে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদকে গ্রেড-২ এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদকে গ্রেড-৩ উন্নীতকরণের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মতামত দেয়া হয়েছে। এমনকি এ বিষয়ে সরকারের পক্ষে আর কোন আইনি ব্যবস্থার সুযোগ নেই বলেও সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপরেও আদালতের রায় বাস্তবায়নে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ফলে গণপূর্ত ক্যাডারের কর্মকর্তারা উদ্বেগে রয়েছেন।
এসব বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হামিদুর রহমানের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।