ঢাকা ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুসংবাদ প্রতিদিন

পোকা দমনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকছেন কৃষক

পোকা দমনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকছেন কৃষক

শেরপুরের নকলায় উচ্চ মূল্যের ক্ষতিকর কীটনাশকের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। ফসলের ক্ষতিকর পোকা দমনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির মধ্যে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ পদ্ধতি ও হলুদ ফাঁদ পদ্ধতির প্রতি কৃষকদের আগ্রহ অকল্পনীয় হারে বাড়ছে। এরফলে নিরাপদ শাকসবজি ও কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম পাওয়ায় এবং কীটনাশকের বাড়তি খরচ কমে যাওয়ায় এই অঞ্চলের কৃষকরা অধিক লাভবান হচ্ছেন। নিরাপদ ফসলের আশায় এবং কম খরচে বেশি লাভ পাওয়ায় এখন সকল মৌসুমের প্রায় সব ফসলের খেতে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ও হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করছেন উপজেলার প্রায় প্রতিটি এলাকার কৃষক। উপজেলার সমস্ত এলাকায় নতুন এ পদ্ধতির ব্যবহার বাড়াতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের নিয়মিত উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উপজেলায় কর্মরত মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাগণ।

মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা জানান, ধান, গম, ভুট্টা, আলু, শাকসবজি ও সরিষাসহ তুলা ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার না করে সেক্স ফেরোমন ট্যাপ (লিউর বা তাবিজ) বা জাদুর ফাঁদ এবং হলুদ ট্যাপ বা হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করায় একদিকে উৎপাদন খরচ কমেছে, অন্যদিকে কৃষকদের অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি তারা নিরাপদ ফসল ও ভালো ফলন পাচ্ছেন। সম্প্রতি চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের বাছুর আলগা, চন্দ্রকোনা, চক বড়ইগাছি, কাজাইকাটা ও গোয়ালের কান্দা এবং চরঅষ্টধর ইউনিয়নের নারায়ণ খোলা এলাকার তুলা খেত ঘুরে দেখা গেছে, সব কয়টি তুরা খেতে কৃষকরা সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ও হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করেছেন। এছাড়া সমগ্র উপজেলার প্রায় সব শাক-সবজি ও ফসলের খেতে এই ফাঁদ ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যবহারকারীদের সুফল দেখে আগ্রহী হচ্ছেন বাকি কৃষকরা। নকলা কটন ইউনিট কর্মকর্তা মো. তোফায়েল আলম জানান, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৯০ হেক্টর জমিতে ১৪৬ জন কৃষক তুলা চাষ করেছেন এবং তারা সবাই নিজ নিজ খেতে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি হিসেবে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ও হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করে সুফল পেয়েছেন।

তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরে উপজেলার প্রায় সকল ফসলের খেতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে চরাঞ্চলের কৃষকদের কাছে এই পদ্ধতিতে পোকা দমনের জয়প্রিয়তা আকাশচুম্বি। ভূরদী খন্দকার পাড়া কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আলহাজ্ব মো. ছায়েদুল হক জানান, তারা এবছর বিএডসির তত্বাবধানে প্রায় ১৫ একর জমিতে বীজআলু রোপণ করেছেন। তারা ক্ষতিকর পোকা দমনে সামান্য পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহারের পাশাপাশি সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ও হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করেছেন। তাতে কৃষকদের উৎপাদন খরচ অনেকটাই কমেছে বলে তিনি জানান। আগামীতে তাদের এই কৃষক সংগঠনের সকল সদস্য কৃষক সব আবাদে কীটনাশকের পরিবর্তে নিরাপদ সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ব্যবহার করবেন। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ১,৮১১ হেক্টর জমিতে শাক-সবজি; ১,৫৯০ হেক্টর জমিতে গোল আলু; ৫,৭৮০ হেক্টর জমিতে সরিষা; ২,২০১ হেক্টর জমিতে ভূট্টাসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করা হয়েছে। এসব আবাদের খেতে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ও হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করতে অনেক এলাকার কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এবং উদ্বুদ্ধকরেই কাজ চলমান আছে। যেকোনো কৃষিপণ্য উৎপাদনে উচ্চ মূল্যের ক্ষতিকর কীটনাশকের পরিবর্তে অধিকাংশ ফসলের খেতে ব্যবহার করা হচ্ছে পরিবেশবান্ধব নিরাপদ এই সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি।

বানেশ্বরদী খন্দকারপাড়া এলাকার কৃষক হেলাল উদ্দিন ও মনিরুজ্জামানসহ অনেকে জানান, দীর্ঘদিন ধরে প্রতি মৌসুমি আবাদে ক্ষতিকর পোকা দমনে কীটনাশক ব্যবহার করতেন। তবে কৃষি অফিসরে পরামর্শে গত কয়েক বছর ধরে তাদের সকল আবাদে কীটনাশকের পরিবর্তে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির ফাঁদ ব্যবহার করে উপকার পেয়ে আসছেন। ভূরদী এলাকার কৃষক মোকলেছুর রহমান বলেন, প্রতি বছর কীটনাশক ব্যবহারে অনেক টাকা ব্যয় হয়ে যায়। এবার ফেরোমন ফাঁদ ও হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করায় সেই টাকা লাগেনি। তাতে কীটনাশক কেনার টাকা বেঁচে গেছে। আগে যেকোন কৃষিপণ্য উৎপাদনে অনেক টাকা খরচ হতো। এখন এই পদ্ধতি ব্যবহার করায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কীটনাশক ব্যবহার করতে হচ্ছে না। ফলে আমাদের উৎপাদন খরচ অনেক টাই কমে গেছে। সব মিলিয়ে এবার অধিক লাভের মুখ দেখবেন বলে তারা আশা করছেন তিনি।

উপজেলার চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের চরমধুয়া গ্রামের অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী সফল কৃষি উদ্যোক্তা শাউদা মোসলেউর রহমান সৌমিক বলেন, আগে কৃষকরা সরিষাসহ তাদের সকল ফসলের খেতে কীটনাশক প্রয়োগের কারণে ফুল সমৃদ্ধ ফসলি জমির পাশে স্থাপন করায় মৌ-খামারের লাখ লাখ মৌমাছি মারা যেতো বা অসুস্থ হয়ে পড়তো। ফলে তখন মধু উৎপাদন কম ছিলো। এখন কৃষকরা সচেতন হওয়ায় সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে মৌ-মাছির কোন ক্ষতি হচ্ছেনা। তাতে একদিকে মৌমাছির অবাদ বিচরনের ফলে নিরাপদ কৃষিপণ্যের উৎপাদন বেড়েছে, অন্যদিকে অধিক মধু পেয়ে আমার মতো মৌমাছির খামারীরাও লাভবান হচ্ছেন। উপজেলার বানেশ্বরদী ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার কৃষি বিষয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মো. মোশারফ হোসাই জানান, আগে সাধারণত শাক-সবজি খেতে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ও হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করা হতো। পরে আস্তে আস্তে সকল ফসলের খেতেই নিরাপদ এই পদ্ধতি ব্যবহার শুরু হয়। আগে মাজরা পোকা দমনে ব্যবহার করা হতো কীটনাশক। এখন সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারে ক্ষতিকর এই পোকা নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। ফলে মাজরা পোকাও মারা যাচ্ছে। এতে করে পরিবেশবান্ধব উপায়ে নিরাপদ কৃষিপণ্য উৎপাদন করছেন কৃষকরা। এই পদ্ধতিটি সকল আবাদে ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে একদিকে কৃষকরা লাভবান হবেন, অন্যদিকে ভোক্তারা নিরাপদ খাদ্য পাবেন। ­

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত