ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কারিগরি শিক্ষা বোর্ড

এখনো বহাল তবিয়তে আওয়ামী সিন্ডিকেট!

এখনো বহাল তবিয়তে আওয়ামী সিন্ডিকেট!

আওয়ামী লীগের সময়ের প্রভাবশালী পরিচালক প্রকৌশলী মো. রকিব উল্লাহ জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় বাগিয়ে নিয়েছেন চেয়ারম্যানের পদ। অন্যদিকে সনদ জালিয়াতির মতো গুরুতর ঘটনা প্রকাশ্যে আসলেও বহাল তবিয়তে আছেন আওয়ামী ঘরানার কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কেপায়েত উল্লাহ। এদিকে বোর্ডের কর্মকর্তারা যখন নিজেদের মতো করে সব বাগিয়ে নিচ্ছেন তখন পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতি ও বাংলাদেশ পলিকেটনিক শিক্ষক পরিষদের নেতারাও। সব কিছুই চলে তাদের ইশারায়। আওয়ামী লীগ আমলে দাপট দেখিয়ে এদের শীর্ষ নেতারা প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পোস্টিং নিয়ে আছেন। গত বছরের ২২ নভেম্বর বোর্ডের মডেল নিয়োগবিধি প্রণয়ন কমিটিতেও এই দুই সংগঠনের দুজন করে সদস্য পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, বোর্ডের কর্মকর্তা এবং শিক্ষক নেতারা এতদিন দাপট দেখাতেন আওয়ামী ঘরানার লোক হিসেবে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর ভোল পাল্টে অনেকেই এখন নিজেদের বিএনপি-জামায়াতের লোক বলে পরিচয় দিচ্ছেন। ১৯৬৭ সালে স্থাপিত কারিগরি শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মান প্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রণ, পরীক্ষা নেয়া ও সনদ প্রদান, নতুন প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেয়া, মূল্যায়ন ও উন্নয়নের সার্বিক দায়িত্ব পালন করে থাকে। বোর্ডের আওতায় বর্তমানে সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বেসরকার, এনজিও ও ব্যক্তি উদ্যোগে ১০ হাজার ৫০০টি বিভিন্ন ধরনের কারিকুলাম পরিচালিত হয়। বোর্ডের আওতায় পরিচালিত ২৯টি কারিকুলামের কোর্স প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, প্রতিষ্ঠান স্থাপন, পরীক্ষা গ্রহণসহ যাবতীয় একাডেমিক কাজ পরিচালনা করে। কিন্তু এসব কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিক্ষক সমিতি ও পরিষদের নেতাদের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষক সংগঠনের নেতারা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের আস্থাভাজন ছিলেন বলে জানা গেছে। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সংগঠনের নেতারা বলছেন, বোর্ডের কোনো কার্যক্রমে তাদের কোনো হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিএম আকতার হোসেন বলেন, ‘এগুলো স্রেফ ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগ। আমরা বোর্ডের কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করি না।’

বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক পরিষদের সভাপতি মো. খালেদ হোসেন নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি দশবছর ধরে ঢাকা পলিটেকনিকে আছি। এ কারণে আমাকে আওয়ামী লীগের দোসর বলা হয়। কিন্তু ১৫ বছর ধরেও তো অনেকে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে তো কেউ কোনো কথা বলছে না।’ যদিও শিক্ষকদের এই পদগুলো বদলিযোগ্য।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এখানকার বর্তমান চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রকিব উল্লাহ জুলাই অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক এক প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের সুপারিশে ২০২৩ সালের ১২ মার্চ জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে বোর্ডের পরিচালক (কারিকুলাম) পদে বসেন তিনি।

অন্যদিকে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কেপায়েত উল্লাহ আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একই এলাকার লোক। যে কারণে তার প্রভাবেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন কেপায়েত উল্লাহ। তার শাখায় সনদ জালিয়াতির মতো ঘটনা ঘটেছে। অথচ তার বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। এখনো আছেন বহাল তবিয়তে।

পলিটেকনিক শিক্ষকদের পাঠদানবিষয়ক কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই ক্লাস পরিচালনা করার ফলে ডিপ্লোমা কোর্সের শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। কিন্তু সেই শিক্ষকদেরই অনেকে প্রেষণে বোর্ডে এসে কারিকুলাম ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্টের কাজ করছেন।

অভিযোগ আছে, ঢাকায় থাকার পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে পলিটেকনিকের শিক্ষকরা বোর্ডে পদায়ন নেন। যেখানে শিক্ষক সমিতির নেতারা বেশি প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। যদিও বোর্ডের নিজস্ব কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ। কিন্তু শিক্ষকরা প্রেষণে এসে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসায় বোর্ডের কর্মকর্তারা হয়ে পড়ছেন কোনঠাসা। জানা গেছে, পলিটেকনিকে বর্তমানে প্রায় ৮৫ ভাগ পদে শিক্ষক নেই। অন্যদিকে শিক্ষক সংগঠনগুলো ভেঙে পড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের কথা বাদ দিয়ে নিজেদের স্বার্থ আদায়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ও বোর্ড হতে তারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিচ্ছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানে শিক্ষক সংকট থাকার পরও অনৈতিক সুবিধা নিয়ে অনেককে অধিদপ্তর ও বোর্ডে পদায়ন করতে কাজ করছেন নেতারা।

মানবেতর জীবনযাপন করছেন স্টেপের শিক্ষকরা : স্কিলস অ্যান্ড ট্রেনিং এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট- (স্টেপ) এর আওতায় নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা দীর্ঘ পাঁচ বছর যাবত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না বলে তথ্য পাওয়া গেছে। যে কারণে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের। এদিকেও নজর নেই শিক্ষক সমিতির নেতাদের। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমান চেয়ারম্যান, সচিব ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অদক্ষতার কারণে সময়মতো পরীক্ষা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় উত্তরপত্র প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হয়। প্রয়োজনীয় উত্তরপত্র না থাকায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা দুইবার পিছিয়ে ডিসেম্বর মাসের এক তারিখ থেকে শুরু করা হয়। এসএসসি (ভোকেশনাল) নবম শ্রেণির পরীক্ষা নভেম্বর মাস হতে পিছিয়ে ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখ থেকে শুরু করা হয়। তাদের অদক্ষতার কারণে সময়মতো উত্তরপত্র প্রস্তুত করতে না পারায় এ ঘটনা ঘটেছে। এসএসসি (ভোকেশনাল) ফাইনাল পরীক্ষা আগামী ১০ এপ্রিল ২০২৫ থেকে শুরু হবে কিন্তু এখনো পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উত্তরপত্র প্রস্তুত করা হয়নি।

এছাড়াও দেশে বড় বড় আইটি ফার্ম ও আইটি প্রফেশনাল থাকা সত্ত্বেও বোর্ডের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে প্রেরণের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যারটি ভারতের একটি সফটওয়্যার কোম্পানি ‘কনসাল্টিং অটোমেটিক বিডি লিমিটেড’ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। যা ভারতে অবস্থিত সার্ভারের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. রকিব উল্লাহ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, এক সময় আসেন, চায়ের দাওয়াত রইল। তখন বিস্তারিত বলব। তাহলেই বুঝতে পারবেন। এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইলে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কেপায়েত উল্লাহর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এছাড়া তার হোয়াটসআপ নাম্বারে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোনো উত্তর দেননি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত