সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ করে কক্সবাজার শহরজুড়ে ছিনতাইকারীদের ভয়াবহ থাবা শুরু হয়েছে। এমনকি দিনের আলোতেই কক্সবাজার শহরে চলাফেরা মুশকিল হয়ে পড়ে। পৃথক কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি জেলা পুলিশকেও। গত কয়েকদিন ধরে ছিনতাইরোধে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে জেলা পুলিশের পৃথক টিম। তার ধারাবাহিকতায় ছিনতাইরোধে জেলা পুলিশের পৃথক সাঁড়াশি অভিযানে আসে ব্যাপক সফলতা। পুলিশের তথ্য মতে, গত ২৫ দিনে কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন স্থানে পৃথক অভিযান চালিয়ে শনিবার পর্যন্ত ৪৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এছাড়া চুরি, ছিনতাই, দ্রুত বিচার আইনের ধারায় ১১টি মামলা রুজু করা হয়েছে। অন্যদিকে ছিনতাইরোধে কক্সবাজার শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অস্থায়ী চেকপোস্ট বসিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞেসবাদ ও তল্লাশি করা হচ্ছে নিয়মিত। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজার শহরের ২০ স্পটে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কয়েকটি গ্রুপে নিয়ন্ত্রিত ছিনতাইকারী চক্র। এসব চক্র শনাক্তে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যার কারণে কক্সবাজার শহর অনিরাপদ হয়ে উঠে। গেল কয়েকদিনে কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কসহ পর্যটন জোনে কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে সচেতন মহলকে। এমনকি এই সব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বনে যান। পর্যটক, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ছিনতাইকারীর কবল থেকে রক্ষা পায়নি খোদ কক্সবাজার শহরে টহলরত পুলিশ। এসব ঘটনার পর ছিনতাইরোধে নানা ছক তৈরি করে কক্সবাজার জেলা পুলিশ। তার ধারাবাহিকতায় কৌশলে সাঁড়াশি অভিযানে নামে জেলা পুলিশ। স্থানীয় কয়েকজন ও পুলিশের তথ্য সূত্র বলছে, বিশেষ করে কক্সবাজার শহরের কলাতলী প্রাইমারি স্কুল, কলাতলী ডিভাইন রোড, সমুদ্রসৈকতের ঝাউবাগান, সৈকত পাড়া, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সামনে, কটেজ জোন, হোটেল কল্লোলের সামনে, জাম্বুর মোড়, হাসপাতাল সড়ক, পেট্রোল পাম্প, পান বাজার, গোলদিঘীর পাড়ে কবরস্থান রোড, বৈদ্যঘোনা ১০ তলার বিল্ডিংয়ের সামনে, বৌদ্ধ মন্দির গেট, জাদিরাম পাহাড়ের উপরে, ক্যাং মাঠে, মাইক সাভির্স রোড, খুরুশকুল রাস্তার মাথা, খুরুশকুল পুরাতন ব্রিজ, বিজিবি ক্যাম্পের আম গাছ তলা ও বাস টার্মিনাল এলাকায় ছিনতাইকারী চক্র দাপিয়ে বেড়ায়। তারা সুযোগ বুঝে ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ৯ জানুয়ারি কক্সবাজার শহরের ডিভাইন রিসোর্টের পাশে ছিনতাইয়ের শিকার হন আবরাহামসহ তিন বন্ধু। তিন বন্ধু মিলে সৈকতে আড্ডা দিতে যান। ফেরার পথে ডিভাইন ইকো রিসোর্টের পাশে মাস্ক পরা পাঁচজন এসে তাদের দিকে ছুরি চালায়। ছিনতাইকারীরদল মোবাইল ও মানিব্যাগ নিয়ে যায়। এর মধ্যে তুহিনের পায়ে বেশ কয়েকবার ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একই দিন বৃহস্পতিবার সকালে কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কের এন্ডারসন রোডে এক এনজিওকর্মী ছিনতাইয়ের শিকার হন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিওতে দেখা গেছে ওই এনজিও কর্মীকে ভোরের আলোতে গতিরোধ করে। এক পর্যায়ে মাটিতে পেলে তাকে মারধর করে এবং মালামাল ছিনিয়ে নেয়।
সর্বশেষ গত ৯ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৮টার দিকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে দুর্বৃত্তরা খুলনার কাউন্সিলর গোলাম রাব্বানীকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এছাড়া গত শুক্রবার ভোরে কক্সবাজার শহরের গোলদিঘি পাড় এলাকায় মোবারক নামের টহলরত এক পুলিশ সদস্যকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় একদল ছিনতাইকারী চক্র। কক্সবাজারে শুধু ছিনতাইয়ে সীমাবদ্ধ নয়, বাসা, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দুর্ধর্ষ চুরিসহ পার্কিং থেকে মোটরসাইকেল চুরির ঘটনাও নিত্যদিনের।
ভুক্তভোগী এনজিওকর্মী ইয়াসিন তোফা জানান, ঘটনার দিন ভোরে তার স্ত্রী কর্মস্থলে যাওয়ার সময় আমার বাসা থেকে ৫ মিনিট দুরত্বে খবর বিতান সড়কে তিনজন ছিনতাইকারী আমার স্ত্রীকে পেছন দিয়ে মুখ চেপে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। এরপর তার বুকের উপর বসে গলায় ছুরি ধরে হাতে থাকা দুইটি স্বর্ণের আংটি ছিনিয়ে নেয়। এরপর ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে ব্যাপক মারধর করে। এক পর্যায়ে তার স্ত্রী ঘটনাস্থলেই জ্ঞান হারান।
ছিনতাইসহ অপরাধ রোধে কাজ করা কক্সবাজার গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি’র ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘গেল ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান পর পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে ছিনতাইচক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। এরই মধ্যে গোয়েন্দা পুলিশ ডিবির তিনটি পৃথক টিম মাঠে কাজ করছে এবং পৃথক অভিযান চালিয়ে দুর্ধর্ষ কয়েকজন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে। তিনি আরো বলেন, ডিবি পুলিশ অভিযানের পাশাপাশি, নিরাপত্তার স্বার্থে অস্থায়ী চৌকি বসিয়ে সন্দেহভাজন লোকজনদেরও তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) জসীম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশি কার্যক্রমে একটু ভাটা পড়েছে। এই সুযোগে অপরাধী চক্র মাথা চড়া দিয়ে উঠছিল। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিছিন্ন কিছু ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। অপরাধ নির্মূলে পুলিশ নিয়মিত কাজ করছে। তার ধারাবাহিকতায় গত ২৫ দিনে কক্সবাজার শহরের আলোচিত ৪৭ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে ১১টি মামলা করা হয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষ দরজা খোলা রেখে ঘুমাতে পারাটাই কক্সবাজার জেলা পুলিশের তৃপ্তি।’
তিনি আরো বলেন, সন্ধ্যার পর থেকে শহরের গুরুত্বপূর্ণ বেশির ভাগ মোড়ে সড়ক বাতি জ্বলে না। অপরাধীরা এর সুযোগও নেয়। বিষয়টি জরুরিভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে পৌরসভা এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগকে তাগাদা দেয়া হয়েছে। সহসাই কক্সবাজার শহরের অলিগলির সড়ক বাতিগুলো সচল করার প্রতিক্রিয়া চলছে।
এদিকে গতকাল শনিবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে পুলিশ সুপার (এসপি) মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ জানিয়েছেন, জেলগেট সংলগ্ন চুইজাল রেস্টুরেন্টের সামনে একদল ছিনতাইকারী পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এক সিএনজি গতিরোধ করে অস্ত্রের মুখে এক ভুক্তভোগীর ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, একটি ডায়মন্ডের রিং (যার মূল্য ৫৫ হাজার) একটি মোবাইল ফোন অন্যান্য সরঞ্জামাদি ছিনি নিয়ে। ঘটনার সাথে ভুক্তভোগী এই বিষয়ে পুলিশকে অভিযোগ করেন। অভিযোগ পেয়ে তাৎক্ষণিক পুলিশের একাধিক দল অভিযান শুরু করে।
অভিযানে পুলিশ তথ্য প্রযুক্তি ও স্থানীয় লোকজনদের সহায়তায় কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ওই ঘটনায় জড়িতসহ ১২ জন পেশাকার ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।
গ্রেপ্তাররা হলেন- কক্সবাজার পৌরসভার টেকপাড়ার মাসুদ হোসেনের ছেলে তানভীর হোসেন প্রকাশ পেটান, প্রকাশ আজাদুর রহমান, কক্সবাজার পৌরসভার পাহাড়তলী এলাকার মো. শফিকের ছেলে মো. ইসমাঈল, পাহাড়তলী ইসুলের ঘোনার এলাকার মো. সরওয়ারের ছেলে ইমরান সরওয়ার ইমন, টেকপাড়ার মো. ফরিদের ছেলে ইরফান ফারদিন, মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোমের খোন্দকার পাড়া এলাকার মো. হোছনের পুত্র সিহাব প্রকাশ খোকন, কক্সবাজার পৌরসভার সমিতিপাড়ার আবুল কাশেমের পুত্র মো. সোহেল, বৌদ্ধমন্দির এলাকার কৃষ্ণ চন্দ্র দাশের ছেলে সুমন কান্তি দাশ, কক্সবাজার পৌরসভার নতুন বাহারছড়া এলাকার মানিক মিয়ার ছেলে মো. হান্নান, পিটিস্কুল এলাকার মো. সেলিমের ছেলে সাইফুল ইসলাম ও মো. হানিফের ছেলে মো. শাহীন প্রকাশ বুলেট (২২), পৌরসভার বাহারছড়ার মৃত ইসমাঈল মাঝির ছেলে হাসান মাহমুদ সাগর প্রকাশ ভিকি এবং টেকপাড়া চৌমুহনী এলাকার মোস্তফা কামালের পুত্র মিজবাউল হক মুন্না।