ঢাকা ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আহতদের চিকিৎসায় অবহেলায় ব্যবস্থা

আহতদের চিকিৎসায় অবহেলায় ব্যবস্থা

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ত্বরান্বিত করতে জীবন বাজি রেখে রাজপথে নেমেছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অসংখ্য ছাত্র-জনতা। ৫ আগস্ট সেই স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটেছে। তার বিনিময়ে প্রাণ হারাতে হয়েছে সহস্রাধিক মানুষকে। এমনকি হাত-পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণসহ বিভিন্ন পর্যায়ে আহত হয়েছেন প্রায় ২০ হাজারের মতো মানুষ। এর মধ্যে আহতদের চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আহত-পঙ্গুত্ববরণ করা এসব মানুষের সুচিকিৎসায় সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। এমনকি তাদের চিকিৎসায় কোনো অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়ারও হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, আহতদের চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বিএসএমএমইউ) ডেডিকেটেড করা হয়েছে। এছাড়াও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর), জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে আহতরা চিকিৎসাধীন। উন্নত চিকিৎসার জন্য এরইমধ্যে ২০ জনকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। তাদের চিকিৎসা কার্যক্রম সরাসরি তদারকি করেছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নিজেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গণঅভ্যুত্থানে ২০ হাজারের মতো মানুষ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আহত হয়েছেন। তবে এর মধ্যে নিবন্ধিত রোগী ১২ হাজারের মতো। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত রোগীদের উন্নত চিকিৎসায় পর্যায়ক্রমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হচ্ছে। এছাড়া চীন, নেপাল, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, রাশিয়া এবং থাইল্যান্ড থেকে একাধিকবার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল বাংলাদেশে এনে আহতদের চিকিৎসা ও পরামর্শ দিচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসএমএমইউয়ের কেবিন ব্লকে চিকিৎসাধীন আহত এক শিক্ষার্থী বলেন, কেবিন ব্লকে ডাক্তার খুবই কম আসেন। অনেক সময় বাইরে থেকে নিজেদের পকেট থেকেই দামি বিভিন্ন ওষুধ কিনে আনতে হয়। নার্সরা সময়মতো কেবিনে থাকেন না। কোনো কিছু বললেও গুরুত্ব দেন না। বিষয়টি নিয়ে কয়েকবার হাসপাতাল পরিচালককে বলা হলেও গুরুত্ব দেননি। এর আগে গত ২ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থানে আহতরা ঠিকমতো উন্নত চিকিৎসা পাচ্ছেন না অভিযোগ করে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন বিএসএমএমইউয়ে চিকিৎসাধীনরা। তাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও উন্নত চিকিৎসা পাচ্ছেন না। চিকিৎসক-নার্সরা ঠিকমতো খোঁজ রাখেন না। বিষয়টি বারবার বলার পরেও কোনো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। এজন্য সড়কে নেমে আন্দোলন করতে বাধ্য হয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম ঘটনাস্থলে এসে আহতদের বুঝিয়ে তাদের হাসপাতালে নেন।

ঢাকায় চিকিৎসা দেবেন সিঙ্গাপুরের ৫ চিকিৎসক : আন্দোলনে গুরুতর আহত চক্ষু রোগীদের আগামী ১-২ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসা দেবেন সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল, ন্যাশনাল আই সেন্টার এবং ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হসপিটাল অ্যান্ড আলেক্সান্দার হসপিটালের বিশেষজ্ঞ রেটিনা, কর্নিয়া, নিউরো অফথ্যালমোলজি এবং অকুলোপ্লাস্টি সার্জনরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুরুতর আহত চক্ষু রোগীদের সেবা দেবেন। মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ওই দুই দিন রাজধানীর দুটি হাসপাতালে সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সেবা দেবেন। এগুলো হলো- জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং ধানমন্ডির বাংলাদেশ আই হসপিটাল। সেখানে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চিকিৎসকরা আহত রোগীদের সেবা দেবেন । সেবা পাওয়ার জন্য জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কর্তব্যরত (০১৩৩৭৩৪৩৩৮৯) এবং বাংলাদেশ আই হসপিটালের কর্তব্যরতদের (১০৬২০) সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটেই ভর্তি আছেন ৯৭ রোগী : রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে বর্তমানে ৯৭ জন আহত রোগী ভর্তি আছেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির সহকারী অধ্যাপক ডা. জাকিয়া সুলতানা নীলা। তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালে বর্তমানে যে ৯৭ জন ভর্তি আছেন, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই সিরিয়াস ইনজুরড। তুলনামূলক কম সমস্যা যাদের ছিল, তারা চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে গেছেন। যারা ভর্তি রয়েছেন, তাদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশেরই চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডা. জাকিয়া সুলতানা বলেন, আগামী ১-২ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুর থেকে পাঁচ সদস্যের একটি চিকিৎসক দল বাংলাদেশে আসছেন। তাদের মধ্যে দুই জন রেটিনা বিশেষজ্ঞ, একজন কর্নিয়া বিশেষজ্ঞ, নিউরো অফথালমোলজি বিশেষজ্ঞ এবং আরেকজন অকুলোপ্লাস্টি বিশেষজ্ঞ থাকবেন। এক্ষেত্রে তাদের কার্যক্রমকে গতিশীল করার জন্য আমরা দুটি সেন্টারে রোগী দেখার আয়োজন করেছি। একইসঙ্গে দুটি হাসপাতালেই আহত চক্ষু রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হবে। তিনি আরো বলেন, চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে বর্তমানে যারা ভর্তি আছেন, তাদের প্রত্যেককেই আমরা সিঙ্গাপুরের চক্ষু বিশেষজ্ঞদের দেখাব। এর পাশাপাশি আমরা বাইরের আহত রোগীদের জন্যও চিকিৎসা পরামর্শের সুযোগ রাখব। আমাদের হাসপাতালে সিঙ্গাপুরের দুই জন রেটিনা স্পেশালিস্ট আসবেন। তারা সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় চক্ষু হাসপাতাল ন্যাশনাল আই হসপিটালের চিকিৎসক।

বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবা নিয়ে সন্তুষ্ট বিদেশি চিকিৎসকরা বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে যাদের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে, তারা দেশেই বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন আহতদের চিকিৎসায় গঠিত সেলের অন্যতম সদস্য ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হসপিটালের সহকারী অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবির হিমু। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা এরইমধ্যে ২০ জনকে বিভিন্ন দেশে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছি। পাইপলাইনে আরো বেশ কয়েকজন আছে। যদিও আমরা আমাদের দেশেই আহতদের জন্য বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করেছি। এখন পর্যন্ত বিদেশ থেকে যারা বাংলাদেশে চিকিৎসাসেবা দিতে এসেছেন, তারা বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তারপরও যদি কোনো ক্ষেত্রে আমাদের চিকিৎসায় ঘাটতি দেখা যায়, সেই চিকিৎসার জন্য আমরা আহতদের বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। ডা. হুমায়ুন কবির বলেন, আহতদের মধ্যে যাদের রোবটিক ফিজিওথেরাপি দরকার ছিল, তাদের কয়েকজনকে থাইল্যান্ড পাঠানো হয়েছে। কারণ আমাদের দেশে রোবটিক ফিজিওথেরাপি নেই। মুসা নামক একজনকে আমরা সিঙ্গাপুরে পাঠিয়েছি, কারণ দেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার ইনফেকশনটা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিল না। তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানোর পর শুধুমাত্র তার জন্যই আলাদা একটি অ্যান্টিবায়োটিক তৈরির মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এর ফলে মুসা সুস্থ হয়ে এখন দেশে আছে। অর্থাৎ আমাদের দেশে যে চিকিৎসাগুলো নেই, ঠিক সেগুলোর জন্যই আমরা অন্যান্য দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। নিউরোসায়েন্স হসপিটালের এই চিকিৎসক আরো বলেন, শুধু চিকিৎসা দিয়েই আমাদের দায়িত্ব শেষ নয়, সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গেলেও আমরা তাদের ফলোআফ করার চেষ্টা করছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা আহতদের জন্য ডেডিকেটেডলি চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে দিয়েছি। প্রত্যেকটা হাসপাতালেই আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চিকিৎসা সেল করে দেয়া হয়েছে। আহতরা যখনই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তাদের আমরা সেবা দেয়ার চেষ্টা করি।

উন্নত চিকিৎসায় এবার তুরস্ক-রাশিয়ায় পাঠানোর উদ্যোগ : আহতদের উন্নত চিকিৎসায় এবার তুরস্ক-রাশিয়ায় পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান। তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ২০ হাজারের মতো মানুষ বিভিন্ন রকম আহত হয়েছে। এর মধ্যে ১২ হাজারের মতো নিবন্ধিত আহত রোগী আমাদের রয়েছে। আমরা তাদের প্রত্যেককেই সর্বোচ্চ সেবা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা চেষ্টা করছি বাংলাদেশে উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদানের। এর বাইরেও আমরা বিভিন্ন দেশ থেকে চিকিৎসকদের নিয়ে এসে চিকিৎসা দিচ্ছি। এমনকি প্রয়োজন অনুসারে দেশের বাইরে পাঠিয়েও চিকিৎসা নিশ্চিত করছি। সায়েদুর রহমান বলেন, আমরা যে ভালো চিকিৎসা দিচ্ছি এর নমুনা হলো গত তিন মাসে মাত্র একজন আহত রোগী মারা গেছেন। বাকি অসংখ্য মুমূর্ষু রোগীকেও আমরা চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলেছি। এই পুরো চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম কিন্তু সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আমরা করে যাচ্ছি। আহত রোগীকে একটি টাকাও খরচ করতে হচ্ছে না। শুরুর দিকে কিছু মানুষ বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে গিয়ে নিজ খরচে চিকিৎসাসেবা নিয়েছে, আমরা সেই অর্থও যথাযথ প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের ফিরিয়ে দিয়েছি। তিনি আরো বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য এখন পর্যন্ত আমরা ২০ জনকে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছে। আমাদের পাইপলাইনে আরো বেশ কয়েকজন আছে। এতদিন আমরা সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ডেই বেশি জোর দিয়েছি। এবার কিছু ভিন্নতাও আসবে। আমরা তুরস্কে পাঠানোর বিষয়ে কথা বলেছি, একজনের জন্য আমরা রাশিয়াতেও কথা বলেছি। সিঙ্গাপুর থাইল্যান্ডের ৫টি হাসপাতালে আমাদের রোগী আছে। আহতদের চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. সাইদুর রহমান বলেন, আমরা আহতদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি। হয়তো দুয়েকটি ক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় আমরা কোনো ধরনের ছাড় দিচ্ছি না। তাদের চিকিৎসায় যদি কোনো অবহেলার প্রমাণ আসে, তাহলে আমরা ব্যবস্থাও নিচ্ছি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত