পিলখানা হত্যাকাণ্ডে শহীদ পরিবারগুলোর সদস্য ও বেঁচে ফেরা সেনা কর্মকর্তারা বলেছেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ছিল বলে জাতি বিশ্বাস করে। যা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত তদন্ত কমিশনের অধিকতর তদন্তে বেরিয়ে আসবে। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের পরিকল্পনাকারী, মদতদাতা ও সহায়তাকারীদের চিহ্নিত করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমেই দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার জোর দাবি জানিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে বলেছেন, অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত বিপথগামী জওয়ানদের নিরপরাধ বলার কোনো সুযোগ নেই। তাদের মুক্তির দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। গতকাল বুধবার রাজধানীর মহাখালীতে রাওয়া ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন থেকে এ দাবি করা হয়। এতে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন পিলখানায় শহীদ লে. কর্নেল লুৎফর রহমান খানের মেয়ে ডা. ফাবলিহা বুশরা।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সংঘটিত হয় পৃথিবীর ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ ও ভয়াবহ ম্যাসাকার। সেদিন নির্মমভাবে হত্যা করা হয় কর্তব্যরত নিরস্ত্র নিরপরাধ ৫৭ বিডিআর অফিসার তথা সেনা কর্মকর্তাকে। তাদের মরদেহ বিকৃত করা হয়, পুড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশে ট্রাকে লোড করা হয়। মরদেহগুলো ক্ষতবিক্ষত করে গণমাটিচাপা দেয়া হয়, ড্রেনে ফেলে দেয়া হয় ও গুম করা হয়।
‘সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে নিরীহ ও নিরপরাধ নারী-শিশুদের টেনেহিঁচড়ে চরম নির্যাতনের মাধ্যমে ধরে এনে কোয়াটার গার্ডে বন্দি করা হয়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বেশিরভাগ অফিসারকেই শারীরিকভাবে চরম নির্যাতন করা হয়। অফিসারদের বাসস্থানে ব্যাপক ভাঙচুর, আগ্নিসংযোগ ও চুরি-ডাকাতি করা হয়। তাদের গাড়ি ভাঙচুর ও আগ্নিসংযোগ করা হয়। ব্যক্তি ও সরকারি সম্পত্তির ব্যাপক ধ্বংসের মাধ্যমে পিলখানাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়।
ডা. ফাবলিহা বুশরা বলেন, বিপথগামী বিডিআর জওয়ানদের ২৫ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত ওই অপরাধের চাক্ষুষ সাক্ষী আমরা শহীদ পরিবার। বেঁচে ফেরা অফিসাররা এবং আপনাদের মিডিয়ার ছবি ও ভিডিও যা সারা পৃথিবী দেখেছে।
তিনি বলেন, সেদিন পিলখানায় প্রায় পাঁচ হাজার বিডিআর সদস্য এবং চার হাজারের মতো অস্ত্র মজুত ছিল। বিডিআর জওয়ানরা আধা ঘণ্টার মধ্য অস্ত্রাগার লুট করে সব অস্ত্র বের করে নেয় এবং সরাসরি কার্নেজে ব্যবহার করে। সেদিন যে শুধু পিলখানায় বিদ্রোহ হয়েছে তা নয়, বিপথগামী বিডিআর সৈনিকদের উসকানির মাধ্যমে সারা দেশের রাইফেল ব্যাটালিয়ান ও ট্রেনিং সেন্টারেও বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।
কার্নেজে পরবর্তী তৎকালীন সরকারের গঠিত আনিসুজ্জামান তদন্ত কমিশন, সেনাবাহিনীর গঠিত সেনা তদন্ত, সিআইডি তদন্ত এবং বিডিআর ইউনিট তদন্তে রাজনৈতিক কারণে পেছনের ষড়যন্ত্রকারীরা বেরিয়ে আসেনি। তবে তাদের তদন্তে বিপথগামী বিডিআর জওয়ানদের সরাসরি অংশগ্রহণে ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির ম্যাসাকার সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। পর্যাপ্ত প্রমাণ এবং শহীদ ও বেঁচে ফেরা অফিসারদের সাক্ষের ভিত্তিতে সিভিল কোর্ট ও বিডিআর কোর্টে বিপথগামী জওয়ানদের দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দেয়া হয়।
সিভিল আদালতে হত্যা ও অস্ত্র-গোলাবারুদের মামলা পরিচালনা করা হয়। যথাযথ বিধি অনুসরণে এবং অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে বিডিআর অর্ডিনেন্সের আওতায় বিডিআর কোর্টে বিদ্রোহের মামলায় জওয়ানদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়।
ডা. বুশরা আরো বলেন, বিডিআর কোর্টের সাজা নিয়ে প্রশ্ন করা মানে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর অফিসারদের তথা সেনাবাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। অতএব অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত বিপথগামী জওয়ানদের নিরপরাধ বলার কোনো সুযোগ নেই এবং তাদের মুক্তির দাবিও সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তাই আমাদের একান্ত দাবি, সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের প্রাপ্য সাজা অবিলম্বে কার্যকরের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে বাহিনীটিকে কলঙ্কমুক্ত করা হোক। সঠিক বিচার না হলে ভবিষ্যতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
তিনি বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী নিয়োগ পাওয়া আইনজীবীরা বিডিআর হত্যা মামলায় সম্পূর্ণ নতুন। এত বড় ঘটনার বিস্তারিত জানার জন্য তাদের পর্যাপ্ত সময় প্রয়োজন। বর্তমানে চলমান মামলা পরিচালনার জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় সংখ্যক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে যথাযথ আইনি লড়াই চালু রাখা এবং এর মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের যথাযথ শাস্তি প্রদানে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে একান্ত অনুরোধ জানান তিনি।
ডা. বুশরা বলেন, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, বিডিআর কার্নেজে অভিযুক্ত/সাজাপ্রাপ্ত সৈনিক ও তাদের পরিবার গত ১৫ বছর কোনো দাবি নিয়ে মাঠে আসতে আমরা দেখিনি। কিন্তু আজ তারা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক দাবি নিয়ে বিপথগামী সৈনিকদের নিরপরাধ দাবির আন্দোলনের মাধ্যমে জাতিকে বিভ্রান্ত করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু করার অপচেষ্টা করছে।