শস্য ভান্ডার খ্যাত শেরপুরের নকলা উপজেলায় এবার সরিষার বাম্পার ফলন হয়েছে। ভালো ফলনের পাশাপাশি এখন পর্যন্ত সরিষার ভালো দাম থাকায় কৃষকের মুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠেছে। নকলার চরাঞ্চলসহ দো-আঁশ মাটির মাঠজুড়ে যেদিকে চোখ যায় শুধু পাকা বা আধাপাকা সরিষা খেত নজরে পড়ে। বিভিন্ন এলাকার কৃষক-কৃষানিরা তাদের খেত থেকে সরিষা উঠানো ও মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। এবার প্রতি একরে ১৫ থেকে ১৭ মণ সরিষা পাচ্ছেন তারা।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৫ হাজার ৭৮০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ করা হয়েছে। গত বছর এর আবাদ হয়েছিল ৫ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে। বরাবরের ন্যায় গত বছরের অর্জনকে এবারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের কথা থাকলেও কৃষকদের মাঝে সরকারি প্রণোদনা ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বীজ-সার বিতরণ এবং অধিক লাভের আশায় কৃষকের আগ্রহ বৃদ্ধির কারণে এবার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে অতিরিক্ত ৪৮০ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ করা হয়েছে। এবার অনুকূল পরিবেশে সরিষার বাম্পার ফলন ও ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকের মুখে ফুটে উঠেছে হাসি।
উপজেলার পাঠাকাটা ইউনিয়নের পলাশকান্দি গ্রামের শিক্ষিত তরুণ কৃষক সেলিম রেজা জানান, তিনি প্রায় ২৫০ শতাংশ জমিতে মধ্যবর্তী ফসল হিসেবে সরিষা আবাদ করেছেন। সরিষা পেঁকে গেছে, তাই উঠানো শুরু হয়েছে। সরিষা তুলে ওই জমিতে বোরো ধান রোপণ করবেন। সরিষা আবাদে তার যা ব্যয় হয়েছে এর দ্বিগুণ লাভ পাবেন বলে তিনি আশাব্যক্ত করছেন। ভূরদী খন্দকার পাড়া কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছাইয়েদুল হকসহ অনেকে জানান, সরিষা একটি মধ্যবর্তী ফসল, তাছাড়া সরিষাতে উৎপাদন খরচ কম, কিন্তু লাভ বেশি পাওয়া যায়। তাই আগাম আমন ধান কাটার পরে ওইসব জমিতে সরিষার আবাদ করা হয়। সরিষা উঠিয়ে ওই ক্ষেতে বোরো আবাদ করা সহজ। সরিষা উঠিয়ে ওই জমিতে বোরো আবাদ করতে অতিরিক্ত চাষ, সার ও পরিশ্রম লাগেনা; কিন্তু ফলন ভালো হয়। তাই দিন দিন সরিষার আবাদ বেড়েই চলছে। উপজেলার সব এলাকার কৃষকরা সরিষার দিকে ঝুঁকছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ সাগর চন্দ্র দে জানান, উপজেলার চন্দ্রকোনা, চরঅষ্টধর, টালকী, পাঠাকাটা, বানেশ্বরদী, গৌড়দ্বার, নকলা ও উরফা ইউনিয়নসহ পৌরসভায় সরিষার আবাদ করা হয়েছে। তবে চন্দ্রকোনা, চরঅষ্টধর, পাঠাকাটা, বানেশ্বরদী ও উরফা ইউনিয়নে আবাদ বেশি হয়েছে।
অন্য এক কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ ফারিহা ইয়াসমিন জানান, সরিষা চাষের উপযোগী সব জমিকে আবাদের আওতায় এনে জমির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা ও কৃষিপণ্য উৎপাদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষকদের পরামর্শ সেবা ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৩ হাজার কৃষককে প্রণোদনা ও ৬ হাজার ৩০০ কৃষককে পুনর্বাসন সহায়তা দেয়া হয়েছে। তারা জানান, এবছর নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে বিনাচাষে ৪৩০ একর জমিতে সরিষা আবাদ করা হয়েছে। নতুন প্রযুক্তিতে আমন ধান কাটার ৭ থেকে ১০ দিনে আগে ধান ক্ষেতে প্রতি বিঘাতে এক কেজি করে সরিষা বীজ বপন করা হয়েছে। ধান কাটার পরে সরিষাতে সামান্য সার ও প্রয়োজনীয় হালকা সেচ দেওয়ায় ভালো ফলন হয়েছে। এতে একদিকে জমি চাষ ও বীজ বপনের আগে জমিতে সার বাবদ খরচ লাগে না, অন্যদিকে জমিতে সঠিক সময়েই বোরো ধান রোপণ করা সম্ভব। আগামী বছর থেকে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে উপজেলায় সরিষার আবাদ অনেক বাড়বে বলে তারা মন্তব্য করেন।
কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিন মেহেদী জানান, এবছর উপজেলায় স্থানীয় জাতের পাশাপাশি বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৭, বিনা সরিষা-৪, বিনা সরিষা-৯, বিনা সরিষা-১১ ও স্থানীয় টরী-৭ জাতের সরিষা আবাদ করা হয়েছে। তবে বারি সরিষা-১৪, টরী-৭ ও বিনা-৯ জাতের সরিষা বেশি চাষ করা হয়েছে। বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রাকৃতিক কোন দুর্যোগের সম্মুখীন না হলে কৃষকরা খরচের তুলনায় কয়েকগুণ লাভ পাবেন বলে তিনি আশা করছেন। তিনি বলেন, সরিষা আবাদ অধিক লাভজনক ফসল হওয়ায় কৃষকরা অলাভজনক অন্য আবাদ ছেড়ে সরিষার দিকে ঝুঁকছেন। সরিষা আবাদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত পরামর্শসহ সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হয়েছে বলেও জানান কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিন মেহেদী।