ঢাকা শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রমজানের ঐতিহ্য বিশ্বজুড়ে

রমজানের ঐতিহ্য বিশ্বজুড়ে

হিজরি সালের নবম মাস হলো রমজান। বিশ্বব্যাপী মাসটি মুসলিম উম্মাহর কাছে পবিত্র ও বরকতময়। এ মাসকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের আয়োজন করে থাকে মুসলিম উম্মাহ। বিশ্বে এক দেশ থেকে অন্য দেশে রমজান পালনের দৃশ্য মৌলিকভাবে এক হলেও কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে সংস্কৃতিতে। বিশ্বজুড়ে রমজানের ঐতিহ্যের বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানাচ্ছেন সানজানা রহমান যুথী-

সংযুক্ত আরব আমিরাত : ‘হক আল লায়লা’ হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের জনপ্রিয় ঐতিহ্য। রমজানের উদযাপন শুরু হয় এর মাধ্যমে। পবিত্র মাস আগমনের এ উদযাপন শুরু হয় ১৫ শাবানে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো রমজানের গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষ এবং শিশুদের মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া। শিশুরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। নাশিদ গেয়ে মিষ্টি সংগ্রহ করে। ‘আতোনা আল্লাহ ইউতিকোম, বাইত মক্কা ইউদিকুম’ ধ্বনি দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যার অর্থ ‘আপনারা আমাদের দিন, আল্লাহ আপনাদের পুরস্কৃত করবেন এবং মক্কা পরিদর্শনের তৌফিক দেবেন।’ এ ছাড়া আরেকটি ঐতিহ্য হলো কামান দাগানো, যা সেহরি এবং ইফতারের সময় করা হয়। রোজাদারকে সঠিক সময় অবহিত করতে।

কুয়েত : কুয়েতের ঐতিহ্য এবং রীতিনীতি সম্পর্কে বলতে গেলে, কারক’আন হলের কথা বলতে হয়। উদযাপনটি তিনদিন ধরে চলে। কুয়েতে রমজান মাসে কুরআন তেলাওয়াত একটি ঐতিহ্য। তরুণদের মনে রমজানের গুরুত্ব জাগিয়ে তোলা কারক’আনের একটি অপরিহার্য অংশ। রমজান উদযাপনের জন্য শিশুরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে নাশিদ গায়। ছেলে এবং মেয়েদের আলাদা নাশিদ আছে। শিশুরা প্রায়ই গানগুলোকে বিশেষ শব্দের সাথে সাজিয়ে তৈরি করে। এ ঐতিহ্য কুয়েতি শিশুদের জন্য আনন্দের। যারা রোজা রাখেন, তাদের মিষ্টি দিয়েও পুরস্কৃত করা হয়।

সৌদি আরব : ঐতিহ্যগতভাবে সৌদি আরবের লোকেরা দীর্ঘসময় উপবাসের পর খেজুর এবং গাহওয়া (আরবি কফি) দিয়ে ইফতার করেন। খাবারের মধ্যে শুরাইক রুটি, দুগগাহ, রুতাব ও সুক্কারিসহ বিভিন্ন ধরনের খেজুর, জমজমের পানি, সামবোসা, গাহওয়া, ফৌল, বালিলা ইত্যাদি থাকে। সৌদি আরবের আরেকটি ঐতিহ্য পবিত্র মাসের ১৩, ১৪ বা ১৫ তারিখ রাতে পালিত হয়। শিশুদের সেরা সাংস্কৃতিক পোশাক পরানো হয়। এরপর তারা প্রতিবেশীদের সাথে দেখা করে, বিশেষ গান গায় এবং বিনিময়ে উপহার গ্রহণ করে। যা আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়ার এবং সম্প্রদায়ের বন্ধনকে শক্তিশালী করার আনন্দদায়ক উপায়।

ইন্দোনেশিয়া : ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের মুসলমানদের জন্য পাদুসান হলো পবিত্র হওয়ার একটি অনুষ্ঠান। যা দেহকে পরিষ্কার করার জন্য করা হয়। রমজান শুরুর আগে তারা পুকুরে নেমে নিজেদের পবিত্র করার জন্য গোসল করেন। ইন্দোনেশিয়ার আরেকটি ঐতিহ্য হলো নাইকার। পবিত্র মাস শুরু হওয়ার আগে তারা এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। জাভা দ্বীপের মুসলমানরা পরিবারের প্রয়াত সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এ আয়োজন করেন। তাদের বিশ্বাস, রমজান মাস একটি নতুন জীবনচক্রের সূচনা এবং পূর্ববর্তী বছরের সমাপ্তি নির্দেশ করে। কিছু গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে পার্থিব নৈবেদ্য উৎসর্গ করে। রমজান মাসে তুরস্কে মাঝরাতে জোরে ঢোলের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। তুর্কি ঢাকি বাদকরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে দাভুল (দ্বি-পার্শ্বযুক্ত ঢোল) তাদের শরীরে বেঁধে তুরস্কের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তারা সেহরির জন্য মানুষকে জাগিয়ে তোলে। তারা আশপাশের এলাকায় নাশিদ গায় এবং ঢোল বাজায়। লোকেরা প্রায়ই ঢোল বাদকদের তাদের বাড়িতে সাহরি খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান।

লেবানন : কামানে তোপধ্বনি দিয়ে ইফতারের সময় হওয়ার বিষয়টি জানানো হয় লেবাননে। এটি সম্ভবত বিশ্বে প্রচলিত রমজানের প্রাচীনতম ঐতিহ্যের একটি। এটি শুরু হওয়ার প্রায় ২০০ বছর পরও লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ আজও এ চর্চা চালু আছে। যা ‘মিদফা আল ইফতার’ নামে পরিচিত।

মিশর : মিশরে রমজানের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে রাস্তা-ঘাট, বাড়ি-ঘর এবং আশেপাশের এলাকা বিশেষ কারুকার্য খচিত হারিকেন দিয়ে আলোকিত করা হয়। তাদের স্বতন্ত্র নকশা এবং জাঁকজমকপূর্ণ কারুকার্যের জন্য হারিকেন ও ফানুস রমজানের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ফানুস যখন অন্ধকার রাস্তা এবং ঘর-বাড়ি আলোকিত করে; তখন তা দেখতে চমকপ্রদ এবং সুন্দর হয়।

মরক্কো : মরক্কোর নাফাররা সেহরির জন্য মুমিনদের জাগিয়ে তোলার দায়িত্বে থাকেন। ঐতিহ্যবাহী গান্ডোরা, টুপি এবং সাধারণ চটি পরে তারা সুরেলা কণ্ঠে নাশিদ গেয়ে হেঁটে বেড়ান। এ শব্দ শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এটি মরক্কোর সবচেয়ে সুন্দর ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে একটি। রমজানের শেষ রাতে এ ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কার দেওয়া হয়।

ঐতিহ্যগত দিক থেকে রমজান মাসের সংস্কৃতি ভিন্ন হলেও সব মুসলিমের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য একই। সবাই মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে পুরো মাস সিয়াম সাধনা করেন। তবে এই ঐতিহ্যগত ভিন্নতা যেন বিশ্ববাসীর কাছে রমজান মাসকে এক অনন্য সুন্দরতম মাস হিসেবে উপস্থাপন করেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত