ঝিনাইদহে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ তামাক চাষ। তামাক চাষিদের সাথে প্রতিযোগিতায় গিয়ে প্রতি বছরই পর্যাপ্ত সার পায় না পেঁয়াজ চাষিরা। জেলার শৈলকুপা ও হরিণাকুণ্ডুতে পেঁয়াজ ও অন্যান্য চাষিরা সার সংকটের অভিযোগ করেন প্রতি বছরই। অন্যান্য ফসলের তুলনায় বেশি লাভজনক হওয়াই প্রতিবছর সর্বনাশা তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছেন এই অঞ্চলের চাষিরা। তামাকজাত পণ্যে বেশি ভ্যাট আরোপ ও বিজ্ঞাপনে নিষেধাজ্ঞা দিলেও তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা যাচ্ছে না। ফলে কমে যাচ্ছে খাদ্যজাত, ডাল ও মসলা জাতীয় ফসলের উৎপাদন। বিগত ৪ বছরে জেলায় তামাক চাষ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
জেলার শহরতলিতে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকোর তামাক ক্রয় কেন্দ্র থাকায় হাতের কাছে একটি নিশ্চিত বাজার তৈরি হয়েছে। সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রয়োগ ও মনিটরিং নেই বলেই বেশি লাভের আশায় কৃষক তামাক চাষে ঝুঁকছেন এমন অভিযোগ সচেতন মহলের। তামাকের বেশি ফলন পেতে অতিরিক্ত সারের ব্যবহারে জেলার বিভিন্ন জায়গায় সারের সংকট দেখা দেয়। জেলার ৬টি উপজেলায় কম-বেশি তামাক চাষ হলেও হরিণাকুণ্ডু, শৈলকুপা, ঝিনাইদহ সদর ও মহেশপুরে বেশি হয়। ঝিনাইদহ কৃষি বিভাগ বলছে, ব্রিটিশি-আমেরিকান টোব্যাকো, জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনালসহ অন্যান্য তামাক বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো চাষিদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে। তারা তামাকের চারা রোপণ থেকে শুরু করে সার-কীটনাশক কেনার জন্য কৃষকদের অগ্রিম টাকা প্রদান করে ও উৎপাদিত তামাক কেনার নিশ্চয়তা দেয়। এই কারণে খাদ্যজাতীয় ফসল বাদ দিয়ে এই অঞ্চলের কৃষকরা তামাক চাষের দিকে ঝুঁকছেন।
ঝিনাইদহ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সংগৃহীত তথ্যমতে, জেলায় ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৬০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়। পরের বছর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৫১ হেক্টর জমিতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৯৩ হেক্টর ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২২৪ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে জেলার মহেশপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ৮৪ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত হরিণাকুণ্ডু উপজেলাতে ১২৪ হেক্টর, ১০২ ও এবছর সর্বোচ্চ ১৫৫ হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক বিঘা জমিতে ৫০০-৬০০ কেজি তামাক উৎপাদন হয়। গতবছর কোম্পানি ২২৬ টাকা দরে প্রতি কেজি তামাক কেনে কৃষকের কাছ থেকে। উৎপাদিত তামাকের বিক্রি নিয়ে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না। তামাকের বাজার স্থির। কোম্পানিই কৃষকের কাছ থেকে সব তামাক কিনে নেয়। তামাক চাষে নিশ্চিত লাভ দেখে কৃষকরা অন্যান্য ফসল বাদ দিয়ে তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার উদয়পুরের তামাক চাষি বিপ্লব বলেন, ‘আলু-পেঁয়াজ চাষ করলে বাজারে কতদামে বিক্রি হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু তামাক চাষ করলে দেশে যাই হোক বিঘাপ্রতি ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা লাভ দেয় কোম্পানি। এ কারণে তামাক চাষ করা।
তিনি বলেন, ‘গত বছর আমার ১০ বিঘা জমিতে তামাকের চাষ ছিল। এ বছরও ১০ বিঘা করেছি।’ হরিণাকুণ্ডু উপজেলার বড়-ভাদড়া গ্রামের কৃষক লিটন মোল্লা বলেন, ‘এ বছর এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছিলাম কিন্তু পরিপক্ব করে ক্ষেত থেকে তুলে বাজারে নিয়ে গিয়ে যে দামে বিক্রি করেছি তাতে বীজের দামই ওঠেনি। পানের বরজ আছে। বাকি টাকায় সার-কিনতে গেলে সারের ডিলাররা আমাদের দিচ্ছে না। তামাক চাষিরা নগদ টাকায় সার কিনে ক্ষেতে দিচ্ছে। তামাকের ক্ষেতে সার লাগে বেশি। যে কারণে আমাদের ইউনিয়নে ঢ্যাপ সারের সংকট দেখা দিয়েছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন নিয়ে কাজ করা এনজিও পদ্মা সমাজ কল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘তামাক চাষিদের বাজারের একটা নিশ্চয়তা রয়েছে যা অন্যান্য ফসল চাষিদের বেলায় নেই। তামাক চাষিদের কোম্পানি থেকে অগ্রিম অর্থ প্রদান করা হয় কিন্তু অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া খুব কষ্টের বিষয়। অন্যান্য ফসলের বাজারের অনিশ্চয়তা থেকেই মানুষ তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছে। তাছাড়া সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সঠিক প্রয়োগ ও মনিটরিং করে না। কৃষি বিভাগও চাষের সঠিক পরিমাণ প্রকাশ না করে গোপন রাখে। তামাক যে একটি ক্ষতিকারক আবাদ এটা কৃষকরা জানেই না। যে কারণে তারাও নির্দ্বিধায় চাষ করে যাচ্ছে। সরকার তৎপর হলেই কেবল তামাক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
হরিণাকুণ্ডু উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরীফ মোহাম্মদ তিতুমীর বলেন, উপজেলায় সবচেয়ে বেশি চাঁদপুর ইউনিয়নে তামাক চাষ করা হয়েছে। চাষিরা তামাক বাজারজাতকারী কোম্পানির নিকট থেকে অগ্রিম আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে। এ কারণে চাষিরা তামাক চাষে ঝুঁকছেন। তামাক চাষিদের চাহিদার কারণে অন্যান্য চাষিরা চাহিদা অনুযায়ী সার পাচ্ছেন না। ফলে অন্যান্য ফসলের আবাদ ব্যাহত হচ্ছে। ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ও জেলা তামাক নিয়ন্ত্রণ কমিটির সদস্য কৃষিবিদ ষষ্টি চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমরা তামাক চাষিদের বিকল্প ফসল চাষে উৎসাহিত করছি। তামাক কোম্পানিগুলো চাষিদের অগ্রিম অর্থ দেয় বলে জেনেছি। সরকার তামাক চাষ নিষিদ্ধ করেনি। কিন্তু আমরা নিয়মিত বিকল্প চাষে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি। আশা করা যায়, আগামীতে তামাক চাষ এই জেলায় কম হবে।’