ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫, ৪ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুসংবাদ প্রতিদিন

কোঁচো সার উৎপাদন করে স্বাবলম্বী

কোঁচো সার উৎপাদন করে স্বাবলম্বী

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার পশ্চিম উজানচরের নবুওছিমদ্দিন পাড়ার গৃহবধূ জাসমা আক্তার (৩৫) এখন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। দুই বছর আগেও প্রতিবেশীদের অনেকেই নাক সিটকালেও ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো সার) উৎপাদন এখন তার জন্য আয়ের বড় উৎস। বান্ধবী তানিয়ার সাফল্য দেখে আগ্রহী হয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। শুরুতে সমালোচনার মুখে পড়লেও এখন কৃষকরা তার কাছ থেকে সার সংগ্রহ করতে আসছেন।

ক্ষতিকর রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে তৃণমূলের কৃষকরা মাটির উর্বরতা কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এ থেকে মুক্তি পেতে কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় তারা কেঁচো সার বা ভার্মি কম্পোস্টের দিকে ঝুঁকছেন। কৃষকদের মতে, কম খরচে ভালো ফলন পেতে জৈব সারের বিকল্প নেই। এ কারণে বাণিজ্যিকভাবে কেঁচো সার উৎপাদন এখন অনেকের জন্য লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেক উদ্যোক্তা, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন সফল নারী উদ্যোক্তা গৃহবধূ জাসমা আক্তার।

২০২৩ সালে ফরিদপুর প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনী মেলায় ঘুরতে গিয়ে বান্ধবীর স্টলে কেঁচো সার দেখে আগ্রহী হন জাসমা। পরে বান্ধবীর কাছ থেকে ১২০০ টাকা কেজি দরে তিন কেজি কেঁচো কিনে আনেন। প্রথমে পরিবারের আপত্তির মুখে পড়লেও উপজেলা কৃষি অফিসের সহায়তায় বিনামূল্যে পাঁচ কেজি কেঁচো সংগ্রহ করে কাজ শুরু করেন। প্রথমদিকে মাসে ১৫-২০ কেজি সার উৎপাদন করলেও এখন এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০-৫০ মণ। তিনি ১৫-২০ টাকা কেজি দরে সার বিক্রি করছেন। গোয়ালন্দের পশ্চিম উজানচরে নিজের ‘জাসমা ভার্মি কম্পোস্ট ও জৈব সার সেন্টার’ গড়ে তুলেছেন তিনি। সেখানে এখন বৈদ্যুতিক চালিত যন্ত্রের মাধ্যমে সার উৎপাদন হয়। তার স্বামী মাহবুবুল আজম এখন পুরোপুরি তার কাজে সহযোগিতা করছেন। এছাড়াও চারজন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন। এছাড়া খামার থেকে গোবর সংগ্রহে আরও কিছু লোক যুক্ত হয়েছেন। এভাবেই প্রতি মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় করছেন জাসমা।

ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক ঘেঁষে গোয়ালন্দের পশ্চিম উজানচর নবুওছিমদ্দিন পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে পূর্বদিকে নেমে যাওয়া পাকা সড়ক ধরে ৫০০ গজ সামনে এগোলে হাতের বায়ে সাইনবোড লাগানো ‘জাসমা ভার্মি কম্পোষ্ট ও জৈব সার সেন্টার’। দুটি টিন শেড ঘরে বসানো বৈদ্যুতিক চালিত যন্ত্র। জাসমা আক্তার যন্ত্রে কেঁচো মাটি দিচ্ছেন আর ছোট দানা বের হচ্ছে। শ্রমিক মোহাম্মদ আলী ছোট দানা (জৈব সার) বস্তা ভরাট করছেন। ঘরের এক পাশে বস্তাভর্তি সার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কৃষকরা এসে বস্তাভর্তি সার নিয়ে যাচ্ছেন। কাজে সহযোগিতা করছেন জাসমার স্বামী মাহবুবুল আজম। তিনি ঢাকায় একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। ছোটভাকলা থেকে আসা কৃষক আব্দুল মতিন বলেন, তিনি ছয় বিঘা জমিতে টমেটো, বেগুন, পেঁয়াজ আর রসুনের আবাদ করেছেন। রাসয়নিক সার ব্যবহারে তার জমির মাটি দুর্বল হয়ে পড়ে। তিনি কৃষি বিভাগের পরামর্শে জৈব সার ব্যবহার শুরু করেন। স্বল্প দামে ভালো মানের সার হিসেবে কয়েক মাস ধরে জাসমা থেকে নিচ্ছেন। তিনি প্রতি মাসে ৫-৬ মণ করে সার নিচ্ছেন। এতে তুলনামূলক খরচ যেমন কম, ফসলের মানও ভালো পাচ্ছেন।

উজানচর নতুন পাড়ার কৃষক হারুন অর রশিদ বলেন, রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার করে পাট, ধান, পেঁয়াজ, রসুনসহ সব ফসল ভালো ফলন দিচ্ছে। প্রতি বিঘায় এক থেকে দেড় মণ জৈব সার ব্যবহার করছেন। এ কাজে দুইজন পুরুষ এবং দুইজন নারী শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন। গ্রাম ঘুরে আরো কয়েকজন গবর সংগ্রহ করেন। যাদের খামার আছে তাদের থেকে ২০-২৫ টাকা বস্তা হিসেবে কিনেন। বস্তাপ্রতি শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে থাকেন। দিন দিন জৈব সারের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ন্যায্য মূল্যে কৃষকদের এ ধরনের কেঁচো সার বা জৈব সার দিতে পারছেন বলে কৃষকরা উপকৃত হচ্ছেন। শ্রমিক মোহাম্মদ আলী জানান, করোনার পর দীর্ঘদিন এলাকায় বেকার বসে ছিলাম। সংসারে টুকটাক কাজ করতাম। দিন মজুর হিসেবে মাঠে তেমন কাজ করতে পারতাম না। পরে ২০২৩ সাল থেকে জাসমা আপনার কারখানায় কাজ শুরু করি। আমার মতো কয়েকজন কাজ করছেন। এ থেকে যে টাকা পাই তা দিয়ে ভালোই আছি।

জাসমা বলেন, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে থেকে এসএসসি পাস করি। সংসারে স্বামী, শাশুড়ি ও দুই কন্যাসন্তান রয়েছে। আমার স্বামী ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তবে আমি চেয়েছি নিজের উদ্যোগে কিছু করতে। তিনি আরও জানান, বর্তমানে তিনি প্রতি মাসে খরচ বাদে ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় করছেন। উপজেলা কৃষি বিভাগ সার তৈরির যন্ত্র ও রিংসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়েছে। এরইমধ্যে তিনি প্রায় পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জাসমা বলেন, আমি শুধু এখানেই থেমে থাকতে চাই না। ভবিষ্যতে বায়োগ্যাস প্রকল্প শুরু করতে চাই। আমার সারের সুনাম যাতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি। জাসমার স্বামী মাহবুবুল আজম বলেন, দুই বছর আগে দেখি ও নিজ থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তখন পরিবার এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীর অনেকেই নাক সিটকাতো। কিন্তু আমি ওর উদ্যোগকে সমর্থন করি এবং পাশে দাঁড়াই। ঘর তৈরিতে সহায়তা দিই, যাতে ও মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, এখন দিন দিন তার উদ্যোগ বড় হচ্ছে। এখানকার সার শুধু গোয়ালন্দেই নয়, রাজবাড়ী, ফরিদপুর এমনকি ঢাকাতেও বিক্রি হচ্ছে। তার এই সাফল্যে আমি গর্বিত। গোয়ালন্দ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. খোকন উজ্জামান বলেন, একদিন জাসমা আমার কার্যালয়ে এসে তার বান্ধবীর ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরির সফলতা দেখে আগ্রহ প্রকাশ করে। তখন আমাদের ‘অনাবাদি পতিত জমির আওতায় প্রদর্শনী প্রকল্প’ চলছিল। আমরা তার জায়গা পরিদর্শন করি এবং কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তাকে কেঁচো, রিং, সিমেন্টসহ আনুষঙ্গিক উপকরণ সরবরাহ করি। পাশাপাশি ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রও প্রদান করি। এখন কৃষি বিভাগে যে পরিমাণ জৈব সারের চাহিদা থাকে, তার একটি বড় অংশই পূরণ হচ্ছে এখান থেকে। তিনি আরও বলেন, শুধু জাসমা নয়, ছোটভাকলায় বিউটি আক্তার নামের আরেকজন গৃহবধূও জৈব সার উৎপাদনে সফল হয়েছেন। একসময় তারা কেউই পরিচিত ছিলেন না, কিন্তু এখন তাদের সফলতার কারণে গোটা গ্রামই পরিচিতি পাচ্ছে। আশপাশের জেলার কৃষকরাও এখন তাদের উৎপাদিত সার ব্যবহার করতে আগ্রহী হচ্ছেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত