জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যারা শহিদ হয়েছেন তাদের পরিবারে এখনও শোকের ছায়া। নেই ঈদের আনন্দ। এসব পরিবারে কেউ হারিয়েছেন বাবা, কেউ বা সন্তান। আট মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও স্বজন হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি পরিবারের সদস্যরা। ফিরতে পারেনি স্বাভাবিক জীবনেও। ঈদ তাদের জন্য আর আগের মতো উৎসব নয়, বরং বেদনার আরেক নাম। কেউ সামর্থ্য থাকলেও কিনছেন না নতুন জামা, খাচ্ছেন না ভালো খাবার। আর কেউ বা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দু’চোখে দেখছেন অন্ধকার। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসসের প্রতিবেদকের সাথে ঈদ প্রস্তুতির বিষয়ে আলাপকালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহদ পরিবারের সদস্যরা এমন কথা জানান। জুলাই অভ্যুত্থানে রাজধানীর মিরপুরের শহিদ মেহেরুন নেছা তানহার মা
আছমা আক্তার বলেন, ‘তানহা ছাড়া আমাদের ঘর অন্ধকার। ঈদের দিন সকালে উঠেই মেয়ে নিজ হাতে পোলাও-মাংসসহ সব রান্না করত। আগের রাতেই সেমাই রান্না করে রাখত। কিন্তু এবার তো আমার মেয়েই নেই। আমাদের আর কিসের ঈদ? মেয়েটা আমার পোলাও-মাংস খেতে খুব পছন্দ করত। তানহা শহিদ হওয়ার পর আমি বাসায় আর পোলাও-মাংস রান্না করিনি।’ রাজধানীর মিরপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহিদ ইমন হোসেন আকাশের মা বেবি আক্তার বলেন, ‘আমার জীবন থেকে সব হারিয়ে গেছে। আমার কোনো ঈদ নেই। আমার জীবনের সব সুখ শেষ হয়ে গেছে। আকাশের বাবা আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমি ছেলেকে নিয়েই ছিলাম। আমার আকাশ আমার কাছে নেই, সে আমাকে রেখে অনেক দূরে চলে গেছে। আমার বুকটা খালি হয়ে গেছে।’ রাজধানীর কাফরুলের ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজের ছাত্র শহিদ ফয়জুল ইসলাম রাজনের বড় ভাই মো. রাজিব বলেন, ‘ভাইকে ছাড়া ঈদ কতটা কষ্টের সেটা বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই। কারণ ঈদের দিন সকাল হলেই ভাই আসত আমার কাছে। দুই ভাই নাস্তা খেয়ে নতুন পাঞ্জাবি পরে এক সঙ্গে নামাজ পড়তে যেতাম। দুই ভাই ঈদের দিন কতো আনন্দ করতাম। ঈদ আসছে আর সেই পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ছে। এ বছর আর ভাইয়ের সাথে নামাজ পড়তে যাওয়া হবে না।’ রাজধানীর বংশালে শহিদ সোহাগের স্ত্রী সাবিনা আক্তার রুনা বলেন, ‘গত বছর স্বামীর সঙ্গে একসঙ্গে ঈদ করেছি। ঈদে যা কিছু দরকার হতো সবকিছুই তিনিই ব্যবস্থা করতেন। একমাত্র ছেলেটার জন্য কত নতুন পোশাক কিনতাম। এবার স্বামী নেই। কারো জন্যই কিছু কেনা হয়নি। ঈদে কী করব বুঝতে পারছি না।’ শহিদ ইসমাইলের মা তাসলিমা আক্তার বলেন, ঈদ আসার কয়েকদিন আগে থেকেই নতুন জামার বাহানা ধরত সে। কখন মার্কেটে নিয়ে যাব, কিনে দেব। আমরা পারিবারিকভাবে সচ্ছল ছিলাম না। ওর বাবা আমাদের সাথে থাকত না। আমি বাসাবাড়িতে রান্নার কাজ করতাম। ওর চাহিদা অনুযায়ী ঈদের কেনাকাটা করে দিতে পারিনি। ছেলেটার কথা মনে হলে বুকটা ফেটে যায়। ছোট মেয়েকেও এ বছর নতুন জামা কিনে দিতে পারিনি। শহিদ মায়া ইসলামের স্বামী মাহবুব ইসলাম বলেন, নাতি আইসক্রিম খেতে চেয়েছিল। নাতিকে নিয়ে বের হলে বাসার নিচে দুজন গুলিবিদ্ধ হয়। মায়া ইসলাম মারা যান। আর নাতি এখন সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন। ছেলে ও বউমা নাতির কাছে। আমি এখন একা। কখন কোথায় থাকি ঠিক নেই। আমার ঈদও নেই। জুলাই আন্দোলনে নিউমাকের্ট এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন কাপড় ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াদুদ। স্ত্রী শাহানাজ বলেন, ‘আমার স্বামী যখন ছিলেন তখন প্রতি বছর কেনাকাটা ও ঈদের আনন্দ করতাম। এ বছর তো উনিই নাই। ওনার অনুপস্থিতিতে ঈদ করব, এটা ভাবতেই পারছি না। একমাত্র ছেলেটার জন্যও কোনো নতুন পোশাক কিনতে যাইনি।’