ঢাকা সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সুসংবাদ প্রতিদিন

শতাব্দী ধরে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে যে পাঠাগার

শতাব্দী ধরে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে যে পাঠাগার

শতাব্দী ধরে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে ঝিনাদহের এনএম খান পাবলিক লাইব্রেরি অ্যান্ড ভিলেজ হল। সারা দিনের সব কর্মব্যস্ততা শেষ করে সন্ধ্যা হলেই লাইব্রেরিতে ছুটে আসেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত পর্যন্ত চলে বিভিন্ন ধরনের বই ও পত্রিকা পড়াসহ কবিতা আবৃত্তি ও গল্পের আসর। আর দিনের বেলায় লাইব্রেরিতে চলে উঠতি বয়সি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কোলাহল। পছন্দমতো বই পড়তে আসে তারা। ভবনে করা নতুন রং ও আধুনিক আসবাবপত্রে সাজানো হয়েছে ভেতরে বাইরে। ইতিহাস ঐতিহ্যে ঘেরা জ্ঞানের আলো ছড়ানো লাইব্রেরিটি সেজেছে যেন নতুন রূপে। দেশের সনামধন্য বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকাও আসে নিয়মিত। আর তাক ভরে সাজানো রয়েছে শত প্রকার স্বনামধন্য লেখকের প্রাচীন দুর্লভ বই। ইতিহাস, ঐতিহ্য, ছড়া, কবিতা, ভূতের ও হাসির গল্পসহ নানা রকম বই স্থান পেয়েছে সেখানে। জ্ঞানের আলো ছড়ানোর পাশাপাশি এই লাইব্রেরিটি এখন স্থানীয়দের বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। লাইব্রেরিতে আসা ভক্তদের খোরাক মেটাতে শুধু বই নয়, আশপাশ দিয়ে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি চা ও ফলের দোকান। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশে পুরোনো পাবলিক লাইব্রেরিগুলোর মধ্যে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার কাঁচেরকোল ইউনিয়নের কচুয়া বাজারে অবস্থিত শতাব্দী প্রাচীন (১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত) বেনীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় সম্মুখে অবস্থিত এনএম খান পাবলিক লাইব্রেরি অ্যান্ড ভিলেজ হল অন্যতম। ১৯৩৭ সালে কাঁচেরকোল গ্রামের স্থানীয় জমিদার কাজী সারোয়ার উদ্দীন ও বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ডা. মো. হাবিবুর রহমানের চেষ্টায় লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে পাবলিক লাইব্রেরি অ্যান্ড ভিলেজ হলটি জ্ঞানের আলো ছড়াতে থাকে। সেসময় টিনের ঘরে লাইব্রেরির কাজ চলত। সে যুগে শিক্ষা বিস্তারে এটি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

১৯৪২ সালে তৎকালীন যশোর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আইসিএস অফিসার এনএম খান (জন্মসূত্রে পাঞ্জাবি) লাইব্রেরিটি পরিদর্শনে আসেন। লাইব্রেরি দেখে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। তার সুন্দর হাতে লেখা পরিদর্শন নোটটি দীর্ঘদিন ধরে লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রয়েছে। লাইব্রেরির ভবন নির্মাণের জন্য তিনি সেই সময় ২ হাজার টাকা অনুদানের ব্যবস্থা করে দেন। এ অনুদানের টাকায় পাকা ভবন নির্মিত হয়। সেই থেকে নাম রাখা হয় এনএম খান পাবলিক লাইব্রেরি অ্যান্ড ভিলেজ হল। তখন বইয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০০।

এরপর থেকেই লাইব্রেরির কলেবর বাড়তে থাকে। দূর-দূরান্ত থেকে পাঠক আসেন বই ও খবরের কাগজ পড়ার জন্য। সে সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। দেশ-দুনিয়ার খবর জানার মাধ্যম ছিল খবরের কাগজ। লাইব্রেরিতে আনা হয় বিখ্যাত মারফি ব্র্যান্ডের রেডিও। তখন উঁচুতে এন্টিনা লাগিয়ে রেডিও শুনতে হতো। সন্ধ্যায় রেডিওতে খবর শুনতে মানুষের ভিড় হতো। কলকাতা থেকেও ডাকযোগে খবরের কাগজ আনা হতো। উল্লেখ্য, রেডিওটির বক্স ও নষ্ট হওয়া যন্ত্রপাতি লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ছিল। সে থেকেই আস্তে আস্তে লাইব্রেরির কলেবর বাড়তে থাকে। বইয়ের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। জমিদার বাড়ির ছেলে এএসএম সাদেক (মলি মিয়া) লাইব্রেরি দেখাশুনা করতেন। অনেক দুর্লভ বইয়ে ভরা প্রাচীন লাইব্রেরি তিনি আপন সন্তানের মতো আগলে রাখতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর অনেকটাই অগোছালো হয়ে পড়ে এটি। কাঁচেরকোল ইউনিয়নের জাগ্রত ছাত্রজনতা এবং বেনীপুর বহুমুখী বিদ্যালয়ের বর্তমান এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা জুলাই বিপ্লবের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এনএম খান পাবলিক লাইব্রেরি অ্যান্ড ভিলেজ হলের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ছোট ছোট শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে পরিষ্কার পরিচ্ছনতা অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে জঞ্জালমুক্ত করে পাঠকদের বসার মতো পরিবেশ তৈরি করেছে। শিক্ষানুরাগী অনেকেই লাইব্রেরির প্রতি ভালোবাসা থেকে এই কোমলমতি ছাত্রসমাজের পাশে দাঁড়িয়েছে। পার্শ্ববর্তী মরিয়ম নেসা বালিকা বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নাজনিন সুলতানা (পলি) সার্বিকভাবে সংস্কার কার্যে সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়েছেন।

বাংলা একাডেমিতে কর্মরত উপ-পরিচালক নাজমা আহমেদ বলেন, তিনিও লাইব্রেরির জন্য বই সরবরাহে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। অনেক শিক্ষার্থী তাদের বাড়িতে থাকা পূর্বপুরুষদের বই লাইব্রেরিতে সংরক্ষণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। অনেকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে লাইব্রেরি সংস্কার কাজে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক বলে জানিয়েছেন। এলাকার দুজন শিক্ষানুরাগীর পক্ষ থেকে ২টি ও পার্শ্ববর্তী মরিয়ম নেসা বালিকা বিদ্যালয় এবং বেনীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ২০০২ ব্যাচের এসএসসি শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ৮টি, মোট ১০টি বাংলা, ইংরেজি ও অর্থনীতিবিষয়ক পত্রিকা লাইব্রেরিটিতে সরবরাহ করা হচ্ছে নিয়মিত। এনএম খান পাবলিক লাইব্রেরি অ্যান্ড ভিলেজ হল আবারও সচল হয়েছে এবং আধুনিকভাবে পুনর্গঠিত হচ্ছে জেনে এলাকার কৃতি সন্তান সাবেক সচিব খন্দকার শহিদুল ইসলামের পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখা ছাত্র-জনতাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখা ছাত্র-জনতার আহ্বানে তিনি লাইব্রেরিটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হতে সম্মতি প্রকাশ করেছেন।

এছাড়াও, বাংলাদেশের বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান ও সাবেক সচিব খন্দকার রাশেদুল হকসহ দেশ-বিদেশে অবস্থানরত বহু শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ এই ঐতিহ্যবাহী পাঠাগার ও সংস্কৃতি কেন্দ্রের পুনর্গঠন কার্যক্রমের সফলতা কামনা করে পাশে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এরইমধ্যে, লাইব্রেরি পুনর্গঠনের লক্ষ্যে শৈলকূপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে একটি সমন্বয় সভা গত ৩১ আগস্ট ২০২৪ইং তারিখে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

উক্ত সভায় লাইব্রেরির জন্য একটি খসড়া গঠনতন্ত্র পেশ করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্নিগ্ধা দাস বলেন, তিনি লাইব্রেরি পুনর্গঠনের কাজে জাগ্রত ছাত্রজনতার পাশে থাকবেন ও পুনর্গঠন কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের তিনি লাইব্রেরির জন্য একটি সংস্কার এবং উন্নয়ন ইস্টিমেট তৈরি করে তার অফিসে জমা দেয়ার জন্য দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। লাইব্রেরি পুনর্গঠনের এই উদ্যোগ এলাকার মানুষের মনে আবার আশার আলো সঞ্চার করেছে। লাইব্রেরিতে পুনরায় ফিরে এসেছে সেই হারিয়ে যাওয়া প্রাণচাঞ্চল্য এবং এটি হয়ে উঠেছে অরাজনৈতিক, সুস্থ-সংস্কৃতি চর্চার এক অভয়ারণ্য। যা এরইমধ্যে এলাকার মানুষের মধ্যে ফের জ্ঞানের আলো ছড়াতে শুরু করেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত