শেরপুরের নকলায় যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই বোরো ধান গাছের সবুজের সমারোহ চোখে পড়ে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার বোরোর বাম্পার ফলনের আশা করছেন কৃষক। চলতি মৌসুমে নকলা উজেলার ১২ হাজার ৪২৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। এরমধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘প্রোগ্রাম অন এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন, এন্টারপ্রেনরশিপ অ্যান্ড রেসিলিয়েন্স ইন বাংলাদেশ (পার্টনার) প্রজেক্টের আওতায় ৩টি প্রদর্শনীতে মোট ৬ একর জমিতে ‘পর্যায়ক্রমে ভিজানো এবং শুকানো সেচ পদ্ধতি তথা সেচ সাশ্রয়ী (এডব্লিউডি)’ নামে নতুন এক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
যদিও এর আগের কয়েক বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘ন্যাশনাল এগ্রিকালচার টেকনোলজি প্রোগ্রাম ফেজ (এনএটিপি-২)’ প্রকল্পের আওতায় বোরো মৌসুমে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এ প্রযুক্তির প্রধান উপকরণ ছোট ছোট ছিদ্র ওয়ালা প্লাস্টিকের পাইপ। তাই এটিকে কেউ কেউ ম্যাজিক পাইপ হিসেবে চিনেন জানেন।
উপজেলা কৃষি অফিসের দেয়া তথ্য মতে, এডব্লিউডি পদ্ধতিটি শুধুমাত্র ধান গাছের কুশি পর্যায় থেকে শুরু করে থোড় আসা পর্যন্ত ব্যবহার করতে হয়। বোরো খেতে এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে কৃষকের ৩০ থেকে ৩৩ ভাগ সেচ খরচ কম লাগে। যেখানে বোরোর কোন জমিতে ১৪ থেকে ১৬টি সেচ দিতে হয়, সেখানে এই পদ্ধতি ব্যবহারে মাত্র ১০ থেকে ১২টি সেচ দিলেই চলে। এতে ফলনের কোন ঘাটতি হয় না বরং খরচ কমে পক্ষান্তরে উৎপাদন ভালো হয়।
এ পদ্ধতিতে জমির ওপর থেকে ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত চারদিকেই ছিদ্র ওয়ালা প্রযুক্তির রাবারের পাইপ পুঁতে রেখে এবং পাইপের মাধ্যমে জমিতে পানির উপস্থিতি দেখে সেচের দেন কৃষকরা। তবে সব কৃষকের মধ্যে এই প্রযুক্তির ব্যবহার ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি, তাই অনেক কৃষক সেচ সাশ্রয়ী এডব্লিউডি প্রযুক্তি সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত নয়। যদিও কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় এবং কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে যেসব কৃষক তাদের বোরো আবাদে এডব্লিউডি প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেচ দিচ্ছেন, সেসব কৃষকদের ৩০ থেকে ৩৩ ভাগ সেচ সাশ্রয় হচ্ছে বলে সরেজমিন কৃষকদের জিজ্ঞাসায় জানা গেছে। বোরো আবাদে সেচ কম লাগায় কৃষকরা আর্থীক ভাবে লাভবান হচ্ছেন বলে অনেকে জানান।
কৃষকার জানান, গত কয়েক বছর পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে এবং বগুড়ার পল্লী উন্নয়ন একাডেমির সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র দেশব্যাপী এই প্রযুক্তি বাস্তবায়নের কাজ করেছে। পানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিস্তার এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি শীর্ষক প্রায়োগিক গবেষণা প্রকল্প পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি প্রদর্শনীর মাধ্যমে এডব্লিউডি প্রযুক্তিটি সব কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দিতে তাদের প্রচেষ্টা ছিল প্রসংশনীয়।
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, গত কয়েক বছর ধরে বোরো আবাদে পরীক্ষামূলকভাবে এডব্লিউডি পদ্ধতি ব্যবহার করে কৃষক আর্থিকভাবে উপকৃত হয়েছেন। ফলে উপজেলার ছোট-বড় সব ধরনের কৃষকের দৃষ্টি এখন এই ম্যাজিক পাইপ তথা এডব্লিউডি প্রযুক্তির দিকে। এ পর্যন্ত যেসকল কৃষক এ পদ্ধতি সম্পর্কে জেনেছেন, তারা সবাই আগামী বছর থেকে বোরো খেতে এডব্লিউডি পদ্ধতি ব্যবহারে আগ্রহী হয়েছেন।
সরেজমিন গনপদ্দী ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাসহ গনপদ্দী পার্টনার ফিল্ড স্কুলের সদস্য এডব্লিউডি প্রযুক্তির ব্যবহারকারী কৃষক আতর আলী, ইন্তাজ আলী ও শরাফত আলীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের পার্টনার ফিল্ড স্কুলের সকল সদস্য এই ম্যাজিক পাইপ ব্যবহারের মাধ্যমে পানির উপস্থিতি দেখে পর্যায়ক্রমে ভিজানো এবং শুকানো সেচ পদ্ধতি তথা সেচ সাশ্রয়ী (এডব্লিউডি) পদ্ধতিতে সেচ দেন।
কৃষক আতর আলী বলেন, ‘বোরো মৌসুমের শুরুতে কৃষি কর্মকর্তারা এসে আমাদের স্কুলের সদস্যদের মধ্যে এডব্লিউডি প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে পরামর্শ সভা করেন। পরে আমরা সবাই সম্মত হলে কৃষি অফিস থেকে আমাদের সারসহ এ প্রযুক্তির বিভিন্ন উপকরণ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে।’
ভূরদী কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আলহাজ ছাইদুল হক জানান, বোরো আবাদে সেচের সমস্যা সমাধানে এডব্লিউডি প্রযুক্তিতে অভাবনীয় সাফলতা এসেছে। অপ্রয়োজনে বোরো খেতে সেচ দেয়ার কোন দরকার নেই। খেতে মাটির পানি ১৫ সেন্টিমিটারের নিচে চলে গেলে তবেই সেচ দেওয়ার প্রয়োজন হয়। মাটির নিচের পানির উপস্থিতি জানতে এডব্লিউডি প্রযুক্তি ব্যহারের বিকল্প নেই। গনপদ্দী ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. অলিউল্লাহ বলেন, ‘বোরো ধানের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কয়েকদিন পর পর জমিতে সেচ দেয়ার কোন দরকার নেই। প্রয়োজনীয় সেচ দিলেই চলে। এক্ষেত্রে এডব্লিউডি প্রযুক্তি ব্যবহার অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলে তিনি মনে করেন।’ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালি মেহেদী বলেন, বোরো ধান আবাদসহ সেচ যোগ্য যে কোন আবাদে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা দরকার। তাতে একদিকে সেচ ব্যয় কমবে, অন্যদিকে পানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হবে। এই প্রযুক্তি কৃষির উন্নয়নে গতি বাড়াতে সক্ষম। তিনি বলেন ‘দেশের সব সেচের ক্ষেত্রে এডব্লিউডি প্রযুক্তি গ্রহণ করলে পানির সুষ্ঠু ব্যবহার ও সেচ ব্যয় কমবে। এতে কৃষক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।