ঢাকা সোমবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বৈশাখ ঘিরে দম ফেলার ফুরসত নেই কারিগরদের

বৈশাখ ঘিরে দম ফেলার ফুরসত নেই কারিগরদের

পহেলা বৈশাখ সামনে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মৃৎ ও কুটিরশিল্প কারিগরদের। সামনে আছে মাত্র একদিন। রাতদিন কাজ করতে হচ্ছে তাদের। সরেজমিন পরিদর্শন করে তথ্য পাঠিয়েছেন কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ প্রতিনিধি-

কুষ্টিয়া : বাংলা লোকসংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ পহেলা বৈশাখ। বৈশাখী মেলা মানেই মাটির তৈরি মালসা থালা আর নানান রঙের হাড়ি-পাতিল। মৃৎশিল্পের জন্য বিখ্যাত কুষ্টিয়ার কুমারখালির কল্যাণপুর গ্রাম। বর্তমানে কল্যাণপুর মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির তৈরি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। তবে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও মূলধনের অভাবে চাহিদামতো পণ্য সরবরাহ করতে পারা যাচ্ছে না। রয়েছে পুঁজির সংকট। কল্যাণপুর গ্রামের ৪০ জন সদস্য মিলে গড়ে তুলেছেন সমিতি। হাঁড়িপাতিল থেকে গৃহস্থালি সব কাজে ব্যাপকহারে ব্যবহার হতো মৃৎশিল্পের নানা তৈজসপত্র। মাটির তৈরি হাঁড়িপাতিলসহ নানান রঙের তৈজসপত্র তৈরিতে বছরজুড়ে ব্যস্ততা থাকলেও বৈশাখকে ঘিরে দম ফেলার ফুরসত নেই কারিগরদের। দেশের তিনভাগের দুইভাগ চাহিদা পূরণ করছেন এখানকার কারিগররা। তাদের মাটির তৈরি হাঁড়িপাতিলসহ নানান রঙের তৈজসপত্র চাহিদা রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ অর্ধশতাধিক দেশে। কারিগর ও বাসিন্দারা বলছেন, ৫ বছর আগেও এ গ্রামে মাটির পাত্র তৈরির কারিগর পরিবারের সংখ্যা ছিল ১৫-২০ জন।

বর্তমানে তা এসে ঠেকেছে প্রায় ৭০ জন। চৈতালি দাস নামে এক কর্মী জানান, মাত্র ৩ হাজার টাকা মাসিক বেতনে প্রায় তিন বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। স্বামী মারা গেছেন। একটি মেয়ে আছে। তাই কোনো উপায় না পেয়ে সংসার চালাতে এ কাজ বেছে নিয়েছেন। শিল্পী নামের আরেক শ্রমিক বলেন, এখানে কাজ করে মাস শেষে যে বেতন দেয় তার তিন ভাগের এক ভাগ যাতায়াতেই খরচ হয়ে যায়। টানাটানির মধ্যে সংসার চালাতে হয়। সমিতির পরিচালক বটোকৃষ্ণ পাল জানান, বর্তমানে বহির্বিশ্বে এ শিল্পের বেশ চাহিদা। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে এ শিল্পের অনেক চাহিদা তৈরি হয়েছে। মফিজুল ইসলাম নামে ঢাকার একজন ব্যবসায়ী এখান থেকে পণ্য নিয়ে কাতারে রপ্তানি করেন।

মাটির তৈরি জিনিসপত্র কিনতে আসা আব্দুল লতিফ বলেন, মৃৎশিল্প বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। তবে এখন সেসব পণ্য নেই বললেই চলে। আসছে পহেলা বৈশাখ তাই কিছু পণ্য কিনতে এসেছি। কুষ্টিয়া জেলা সমবায় অফিসার আনিছুর রহমান বলেন, প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের ব্যবহার কমে গেছে অনেকাংশে। এ শিল্পের জায়গা দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিকসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী। তবে আশার কথা পহেলা বৈশাখ উপলেক্ষে কুষ্টিয়ার তৈরি মাটির তৈরি এসব জিনিসপত্র আবারও নতুন করে সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। তিনি জানান, এই শিল্পের উন্নয়নসহ প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিতে একটি প্রকল্প ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তবে তা এখনো অনুমোদন হয়নি। আশা করছি, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এই মৃৎশিল্পের হারানো গৌরব ফিরে পাবে। কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাস তৌফিকুর রহমান বলেন, কুমারখালি কল্যাণপুর গ্রামের মাটির তৈরি হাঁড়িপাতিলসহ নানান রঙের তৈজসপত্র চাহিদা রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ অর্ধশতাধিক দেশে। এই ঐতিহ্যকে ধরে রেখে মাটির তৈরি হাঁড়িপাতিলসহ নানান রঙের তৈজসপত্র বিদেশে পাঠাতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঋণ সুবিধাসহ সব ধরনের সহযোগিতা থাকবে।

ঝিনাইদহ : পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে দিনরাত চলছে বাঁশ-বেত দিয়ে কৃষি ও গৃহস্থালীর জিনিস তৈরির কাজ। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বৈশাখী মেলায় এসব পণ্য বিক্রি করার জন্যসকালে ঘুম থেকে উঠেই শুরু হয় কুটির শিল্পের কাজ। চলে আবার রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত। পরিবারের সবাই মিলে কাজ করে তৈরি করছে বাঁশ-বেতের জিনিসপত্র। তৈরি শেষে করা হচ্ছে রঙ। পাইকাররা এসে এসব পণ্য কিনে নিয়ে যাচ্ছে বৈশাখী মেলায় তুলবে বলে। বৈশাখ উপলক্ষে এমন কর্মব্যস্ততা চলছে ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার কোলা এলাকার সন্ন্যাসী পাড়ার দাস সম্প্রদায়ের পরিবারগুলোতে। এ গ্রামের সন্ন্যাসী পাড়ায় কমপক্ষে ৪৫টি দাস সম্প্রদায়ের পরিবার বাস করছেন। সব পরিবারের ঘরের আনাচে-কানাচে বাঁশ-বেতের তৈরি জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বাড়ির মধ্যে বসে বাঁশ বেত হতে ধারালো দা-বঁটি দিয়ে নিপুণ হাতে কেউ তুলছেন বেতি বা চটা। আর এগুলো দিয়ে কেউ বুনছেন চাটাই, ডোল, ঝুড়ি, ডালা, কুলা, টেপারীসহ বিভিন্ন কৃষি ও গৃহস্থালী জিনিসপত্র। আবার কেউ ব্যস্ত তৈরিকৃত গৃহস্থালী জিনিসপত্রে রঙ দিয়ে নকশা ও বাজারজাত করতে।

কারিগররা জানান, তাদের অধিকাংশ পরিবারেরই মাঠে কোন চাষযোগ্য জমি নেই। বসত ভিটের দু’এক কাঠা জমিই তাদের সম্বল। তারপরও পূর্ব পুরুষদের বাঁশ বেতের কুটির শিল্পের পেশা আকড়িয়ে প্রতিদিনের কম বেশি রোজগারের মাধ্যমে টিকে আছেন। অনেকে হয়েছেন স্বাবলম্বী। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালানোর পাশাপাশি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে চলছে তাদের সংসার। সংসারে আয় রোজগারে এটাই তাদের একমাত্র পেশা। পূর্ব পুরুষদের হতে ধারাবাহিক ভাবে পাওয়া এ পেশা আকড়ে ধরে বেঁচে আছেন তারা। এখন তাদের মধ্যে দু’একজন অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়লেও তাদের পরিবারের মহিলারা সবাই গৃহস্থালী কাজের পাশাপাশি সারা বছর ধরে বাঁশ বেতের জিনিসপত্র তৈরি করে থাকেন। আর এগুলো পাইকাররা বাড়ি থেকেই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে বৈশাখের আগে কাজের চাপ বেশি থাকে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত