সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার মেয়র এবং উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক নির্ধারণের খবরটি সঠিক নয়। এসব পদে প্রার্থীদের জন্য কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করেনি স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হয়, মেয়র বা চেয়ারম্যান হতে হলে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হবে। এমনকি বলা হয়, নিরক্ষর বা স্বল্পশিক্ষিত কেউ আর এসব পদে নির্বাচন করতে পারবেন না।
বিষয়টি জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান তোফায়েল আহমেদ বলেন, ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক করার প্রস্তাবটি সত্য নয়। আমরা কেবল অগ্রাধিকারের বিষয়টি উল্লেখ করেছি। এমন বাধ্যবাধকতা দিলে তা আদালতে টিকবে না।
তিনি জানান, সংস্কার কমিশন এরইমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রাথমিক সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। খুব শিগগিরই চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।
এদিকে, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রাথমিক সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদণ্ডএসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মেয়র ও চেয়ারম্যান পদে আর জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন না করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার কাঠামোকে দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। একটি বিধানিক অংশ, অন্যটি নির্বাহী অংশ। বিধানিক অংশের প্রধান হবেন ‘সভাধ্যক্ষ’, যিনি জাতীয় সংসদের স্পিকারের মতো দায়িত্ব পালন করবেন। নির্বাহী প্রধান হবেন মেয়র বা চেয়ারম্যান। নির্বাচিত কাউন্সিলর বা সদস্যরা পরিষদের প্রথম সভায় ভোট দিয়ে একজন সভাধ্যক্ষ নির্বাচিত করবেন। পরে সভাধ্যক্ষের সভাপতিত্বে মেয়র বা চেয়ারম্যান নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে।
সুপারিশ অনুযায়ী, জনগণের সরাসরি ভোটে কেবল কাউন্সিলর বা সদস্যরা নির্বাচিত হবেন। পরবর্তীতে তারা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে সভাধ্যক্ষ হিসেবে এবং সভাধ্যক্ষের সভাপতিত্বে মেয়র বা চেয়ারম্যান নির্বাচন করবেন। চেয়ারম্যান বা মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আইন অনুযায়ী তিন বা পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি নির্বাহী কাউন্সিল গঠন করবেন, যা পরিষদকে অবহিত করার জন্য সভাধ্যক্ষের কাছে উপস্থাপন করা হবে। এই নির্বাহী পরিষদের এক-তৃতীয়াংশ সদস্য নারী হবেন। পরিষদ চাইলে নির্বাহী কাউন্সিলের কোনো সদস্যের ব্যাপারে আপত্তি জানাতে পারবে। এমন পরিস্থিতিতে চেয়ারম্যান বা মেয়র নির্বাহী কাউন্সিল পুনর্গঠন করতে পারবেন। সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, চেয়ারম্যান ও মেয়রের ক্ষেত্রে স্নাতক এবং নির্বাহী সদস্যদের জন্য মাধ্যমিক পাস শিক্ষাগত যোগ্যতাকে অগ্রাধিকারযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
বর্তমানে স্থানীয় সরকারের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের জন্য রয়েছে পৃথক আইন ও বিধিমালা। সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে, এসব আইন-বিধি বাতিল করে দুটি একীভূত আইনি কাঠামো গঠন করা হোক। এ ক্ষেত্রে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদের জন্য একটি আইন ও পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের জন্য আরেকটি আইন প্রণয়ন করার সুপারিশ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে থাকা গ্রাম আদালত বিলুপ্তির প্রস্তাব করেছে সংস্কার কমিশন। এক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে, এডিআর (বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) পদ্ধতিকে অধিকতর কার্যকর ও স্বচ্ছ করতে বিচারকের এখতিয়ার ও প্রশাসনিক সহায়তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশনের বিচারবিষয়ক প্রধান সুপারিশ হবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া সারা দেশের সব উপজেলায় আগামী দুই বছরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত স্থাপন করা। পাশাপাশি, প্রতিটি উপজেলায় একজন জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ নিয়োগ এবং তার নেতৃত্বে ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর)’ প্রক্রিয়ার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইউনিয়ন পরিষদের অধীন গ্রাম আদালত বিলুপ্ত করে ওয়ার্ড পর্যায়ের শালিসি ব্যবস্থাকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া। সেই সঙ্গে সালিস কার্যক্রম তত্ত্বাবধান, সালিসকারীদের প্রশিক্ষণ এবং শালিসের আপিল শুনানির দায়িত্ব এডিআর আদালতের বিচারকের ওপর ন্যস্ত করার কথা বলা হয়েছে। প্রশাসনিক সহায়তাও তারা পাবেন। কমিশন মনে করে, প্রতিটি ইউনিয়নে ন্যূনতম ৯টি ও সর্বাধিক ৩০টি ওয়ার্ড থাকতে পারে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে এই ওয়ার্ড সংখ্যা নির্ধারণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রতিটি উপজেলা ও জেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য তিনটি করে ওয়ার্ডে বিভক্ত হবে এবং প্রতিটি ইউনিয়ন তিন থেকে পাঁচটি ওয়ার্ডে ভাগ করা হবে। তবে এসব ওয়ার্ডের কোনো প্রশাসনিক বা নির্বাহী দায়িত্ব থাকবে না। ওয়ার্ড সদস্যরা কেবল পরিষদ বা কাউন্সিলের বিধানিক দায়িত্ব পালন করবেন।
সরকারি চাকরিজীবীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়েও সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের সাধারণ সদস্য পদে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীরা নিজ নিজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে স্বপদে থেকেই প্রার্থী হতে পারবেন। তবে নির্বাচিত হলে তারা পরিষদের সার্বক্ষণিক কোনো পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। তারা কেবল সাধারণ সভা, অধিবেশন বা স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।