ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

হামলা বন্ধ না হলে ‘কালো কফিন’ যাবে ইসরায়েলে

হামলা বন্ধ না হলে ‘কালো কফিন’ যাবে ইসরায়েলে

ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের সামরিক শাখা গাজা উপত্যকায় আটক ইসরায়েলি বন্দিদের পরিবারকে সতর্ক করে বলেছে, ইসরায়েলি সরকারের নিরলস বোমাবর্ষণের ফলে তাদের আত্মীয়স্বজন শিগগিরই নিহত হতে পারেন। গত মঙ্গলবার এক ভিডিও বার্তায় আল-কাসসাম ব্রিগেডস পরিবারগুলোকে সম্বোধন করে বলেছে, গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধ এবং নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের কারণে বন্দিদের জীবন মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। ভিডিওতে বলা হয়, ‘বন্দিদের পরিবার প্রিয় সদস্যরা, প্রস্তুত থাকুন। শিগগিরই আপনাদের সন্তানরা কালো কফিনে করে ফিরে যাবেন। আপনাদের সেনাবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে তাদের লাশগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। এখনই তাদের সমাধি প্রস্তুত করুন। আপনাদের প্রধানমন্ত্রী গাজা উপত্যকায় বন্দিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করেছেন। অপেক্ষা করুন, শিগগিরই দেখতে পাবেন।’ ভিডিওতে এর আগে যুদ্ধে নিহত বন্দিদের লাশ হস্তান্তরের দৃশ্যও দেখানো হয়।

মার্কিন বন্দির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

গাজাজুড়ে ইসরায়েলি বিমান ও স্থলহামলার কারণে বন্দি ইসরায়েলি-আমেরিকান এডান আলেক্সান্ডারকে আটক রাখার দায়িত্বে থাকা ইউনিটের সঙ্গে হামাসের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘোষণা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পর এই বিবৃতি দেয়া হয়। গত মঙ্গলবার হামাস বলেছে, যেখানে ওই জিম্মিকে আটকে রাখা হয়, সেই এলাকায় ইসরায়েলি হামলার পর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এর আগে ২১ বছর বয়সি সৈনিক এডান আলেকজান্ডারকে একটি ভিডিওতে দেখা যায়। ভিডিওটি প্রকাশ করেছিল ওই হামাস। হামাসের মুখপাত্র আবু ওবাইদা এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা ঘোষণা করছি যে, সৈন্য এডান আলেকজান্ডারকে আটককারী গোষ্ঠীর অবস্থানে সরাসরি ইসরায়েলি হামলার পর তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমরা তাদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি।’ ২০২৩ সালে ইসরায়েলে হামাসের অভিযানের সময় ২৫১ জনকে বন্দি করে গাজায় আনা হয়। যার মধ্যে ৫৯ জন বর্তমানে গাজায় আছেন। তাদের মধ্যে ২৪ জন জীবিত বলে মনে করা হয়। বন্দিদের মধ্যে পাঁচজন মার্কিন নাগরিক। তবে, তাদের মধ্যে আলেকজান্ডারই একমাত্র জীবিত বলে মনে করা হয়। গত শনিবার হামাস আলেকজান্ডারের একটি ভিডিও প্রকাশ করে। যেখানে তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে তার মুক্তির জন্য হামাসের সঙ্গে আলোচনার অনুরোধ জানান। ভিডিওতে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘আমি এখনও কেন বন্দি?’ এই ভিডিও এমন এক সময় প্রকাশিত হয়, যখন ইহুদিরা স্বাধীনতা উদযাপনের সপ্তাহব্যাপী উৎসব ‘পাসওভার’ পালন শুরু করেন। ইডানের পরিবার এক বিবৃতিতে বলেছে, গাজায় ইডান এবং আরও ৫৮ জন বন্দি থাকা অবস্থায় এই উৎসব তাদের জন্য স্বাধীনতার কোনো বার্তা বহন করছে না। তিনি বন্দি মুক্তিতে আন্তরিক পদক্ষেপ না নেয়ার জন্য নেতানিয়াহুর সরকারকে অভিযুক্ত করেন।

হামাসের অভিধানে ‘আত্মসমর্পণ’ নেই

বিদেশে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান সামি আবু জুহরি গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, তাদের চিন্তায় আত্মসমর্পণ বলতে কিছু নেই। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্য গাজা উপত্যকায় নির্লজ্জ গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। জুহরি বলেন, ‘ফিলিস্তিনিরা কখনও আত্মসমর্পণ করেননি; সাহসী ফিলিস্তিনি জাতির গৌরব রক্ষায় এ পথেই চলব আমরা।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ফিলিস্তিনিদের বৈধ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে যুদ্ধবিরতি উদ্যোগে তারা ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছেন; তবে হামাস কখনও সাদা পতাকা উত্তোলন করবে না এবং দখলদারদের প্রতিহত করতে সব ধরনের উপায় অবলম্বন করবে। তিনি অবরোধের মাধ্যমে গাজার নিরীহ জনগণকে ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহারে রেখে সম্মিলিত শাস্তি দেয়ার তীব্র নিন্দা জানান। আবু জুহরি বলেন, ‘দখলদাররা গণহত্যা চালাচ্ছে, নিরীহ পরিবারগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করছে এবং শিশুদের অনাহারে রেখে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে।’ তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করে বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলকে ব্যাপকভাবে অস্ত্র সরবরাহ করে এবং নেতানিয়াহুকে শাস্তি পাওয়া থেকে রক্ষা করে গাজায় রক্তপাত ও ধ্বংসযজ্ঞে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। গাজার মানুষকে নির্বিচার হত্যায় ট্রাম্পও সমান অপরাধী বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিবৃতিতে গাজার মানবিক বিপর্যয়ের মুখে নীরব থাকায় আরব দেশগুলোর সমালোচনা করেন আবু জুহরি। আরব শাসকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘দেড় মাস ধরে গাজায় এক টুকরো রুটি বা এক বোতল পানি প্রবেশ করেনি, আপনাদের লজ্জা হয় না? গাজার বাসিন্দার ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বসবাস করছেন, আর আপনারা নেতানিয়াহুর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।’

ইসরায়েলের নতুন প্রস্তাব, হামাসের ‘না’

দেড় বছরের আগ্রাসনে ৫১ হাজার মানুষকে হত্যার পর গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য নতুন একটি প্রস্তাব দিয়েছে ইসরায়েল। এতে হামাসসহ অঞ্চলটির প্রতিরোধ সংগঠনগুলোকে নিরস্ত্র করার শর্ত দেয়া হয়েছে। তবে এমন দাবি সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে হামাস। নিরস্ত্র করার শর্তকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব আখ্যায়িত করে দলটি বলছে, এ ধরনের শর্ত একইসঙ্গে অসম্ভব ও অসম্মানজনক। প্রকৃতপক্ষে শান্তি প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্যই এই কৌশল নিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী। সামি আবু জুহরি বলেন, ‘আমরা আমাদের জনগণের দুর্ভোগ লাঘব করে এমন সব প্রস্তাবের প্রতি ইতিবাচক, তবে ইসরায়েল যেভাবে আত্মসমর্পণের কথা বলছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নেতানিয়াহু এমন শর্ত দিচ্ছেন, যা আদতে যুদ্ধবিরতির পথ রুদ্ধ করার পাঁয়তারা। তারা শুধু একতরফাভাবে নিজেদের বন্দিদের ফেরত চান। আবু জুহরি বলেন, ‘হামাসের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। ইসরায়েল যদি যুদ্ধ বন্ধ করে এবং গাজা থেকে সম্পূর্ণভাবে সেনা প্রত্যাহার করে, তাহলে আমরা জীবিত ও মৃত বন্দিদের মুক্তি দিতে প্রস্তুত। কিন্তু আত্মসমর্পণের কোনো সুযোগ নেই। আমাদের প্রতিরোধের সব পথ অব্যাহত থাকবে।’ মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই জানিয়েছে, তারা ইসরায়েলের খসড়া যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের একটি কপি হাতে পেয়েছে। এতে ১২টি শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রথম সপ্তাহে অর্ধেক ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দিলে গাজায় খাদ্য ও মানবিক সহায়তা প্রবেশের সুযোগ দেয়া হবে। রয়টার্স জানিয়েছে, মধ্যস্থতাকারী দেশ মিসর ও কাতারের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সম্প্রতি হামাসের কাছে ওই খসড়া প্রস্তাব পৌঁছে দেয় ইসরায়েল। তবে হামাসের তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও কোনো চূড়ান্ত জবাব দেয়া হয়নি। ফলে মধ্যস্থতাকারীরা হামাসের আনুষ্ঠানিক উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছেন। হামাসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, তারা প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করে দেখছেন এবং যত দ্রুত সম্ভব আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাবেন। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই প্রতিক্রিয়া জানানো হতে পারে বলে মিডলইস্ট আইকে আভাস দিয়েছেন হামাসের এক নেতা।

গাজাবাসীর দুর্দশা বন্ধ চায় ফ্রান্স

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ গাজার হাসপাতালে ইসরায়েলের হামলায় ক্ষুব্ধ। মানুষের দুর্দশা বন্ধ করতে চান তিনি। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে ম্যাক্রোঁ বলেছেন, গাজায় মানুষের দুর্দশা যেন অবিলম্বে বন্ধ হয়। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইসলরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, একমাত্র যুদ্ধবিরতি হলেই বাকি পণবন্দিরা মুক্তি পাবেন। মঙ্গলবার নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন ম্যাক্রোঁ। তারপর এক্সে তিনি লিখেছেন, গাজার বেসামরিক মানুষের দুর্দশা বন্ধ হওয়া দরকার। মানবিক ত্রাণসাহায্য গাজায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কোনো বাধা দেয়া উচিত নয়। জাতিসংঘও জানিয়েছে, কয়েক সপ্তাহ ধরে গাজায় কোনো ত্রাণ সাহায্য যায়নি। ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। গত সপ্তাহে ম্যাক্রোঁ বলেছিলেন, আগামী জুনে জাতিসংঘের সম্মেলনে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে ফ্রান্স স্বীকৃতি দিতে পারে। ইসলরায়েল জানিয়েছে, স্বীকৃতি দেয়ার সময় এখনও আসেনি। নেতানিয়াহুর অফিস এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা ফরাসি প্রেসিডেন্টের এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধী। কারণ, এই স্বীকৃতির অর্থ হলো, সন্ত্রাসকে পুরস্কৃত করা।

আরও ২৩ ফিলিস্তিনি নিহত

আনাদোলুর খবরে বলা হয়, গাজা উপত্যকাজুড়ে ইসরায়েলের নৃশংস হামলা থামছে না। ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞ থেকে বাদ পড়ছে না শিশুরাও। চলমান নৃশংসতার মধ্যেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার গাজার উত্তরাঞ্চলে সফর করেছেন বলে জানিয়েছে তার দফতর। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় চলমান বিমান ও স্থল অভিযান চালিয়ে যাওয়ার মধ্যেই এই সফরটি অনুষ্ঠিত হয়। তবে সফরের বিষয়ে বিস্তারিত আর কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি নেতানিয়াহুর কার্যালয়। আলজাজিরার খবরে বলা হয়, ইসরায়েলি হামলায় মঙ্গলবার সকাল থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত অন্তত ২৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় এ পর্যন্ত প্রায় ৫১ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত সোয়া ১ লাখ মানুষ। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৫ হাজারের বেশি শিশু রয়েছে বলে চলতি মাসের শুরুর দিকে জানিয়েছিল জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ। আহত হয়েছে ৩৪ হাজারের বেশি শিশু। মঙ্গলবার গাজার মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হামলায় এ পর্যন্ত গাজার অন্তত এক হাজার ৪০০ স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন। ৩৬০ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে ধরে নিয়ে গেছে ইসরায়েল।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত